তুরস্ক ১৯৫৫ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে আলজেরিয়ার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ওপর অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ না করে অর্থাৎ ভোটদানে বিরত থেকে পক্ষান্তরে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেছিল। পাশ্চাত্যঘেঁষা ওই পররাষ্ট্রনীতির জন্য তুরস্ককে ধন্যবাদ। একটি অভিন্ন ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার থাকা সত্তে¡ও রাজনৈতিক ও আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে তুরস্ক ও আলজেরিয়ার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধকালীন পুরো সময়টা জুড়েই সম্পর্কের ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় ছিল। এমনকি দু’দেশের মধ্যকার কঠিন পর্দা সরে গেলেও তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য অভিন্ন ভিত্তি খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়। যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারসাম্যের ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। বিশ্বের সবচেয়ে কম শান্তিপূর্ণ অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যের কথাই ধরা যাক। এখানে এমনকি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এবং নজিরবিহীনভাবে রাজনৈতিক গতিধারার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে দূরত্ব বজায় রাখার পর তুরস্ক ও আলজেরিয়া সম্প্রতি তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। এই গৃহযুদ্ধের কারণেই দু’দেশ বারবার উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সভায় মিলিত হয় এবং কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। তুরস্ক লিবিয়ায় তার রাজনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতি জোরদার, মিসরের সাথে সমস্যার ব্যাপারে মনোযোগ প্রদান ছাড়াও তিউনিসিয়া ও মরক্কোর সাথে সতর্কতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখছে। লিবিয়া সীমান্তসংলগ্ন আলজেরিয়ার সাথে সম্পর্ককে আঙ্কারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ তুরস্ক লিবিয়ায় নিজে সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। উল্লেখ্য, ফ্রান্স মানসিকভাবে লিবিয়াকে তার পেছনের উঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। আলজেরিয়া লিবিয়া সীমান্তের সাথে যুক্ত থাকায় সঙ্গত কারণেই আঙ্কারা আলজেরিয়ার সাথে তার সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে।
ফ্রান্সের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন লি পয়েন্টের সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেল মাজিদ তিবোনি বলেছেন, তুরস্কের সাথে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার দেশ ফ্রান্সের কাছে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ‘আলজেরিয়ার সাথে তুরস্কের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াই দেশটি আলজেরিয়ায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। কেউ আমাদের এই সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হলে তার উচিত আমাদের দেশে নিজেরাই বিনিয়োগ করা।’ তিনি বলেন, ফ্রান্সের আঞ্চলিক প্রভাব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লিবিয়ার অস্থিতিশীলতায় উদ্বিগ্ন আলজেরিয়া তুরস্কের সাথে সম্পর্ককে তার ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণ নীতির অংশ’ বলে মনে করে। প্রেসিডেন্ট তিবোনি তুরস্কের সাথে ৩২ বছর ধরে মুলতবি থাকা সম্পর্ককে দৃঢ়ভাবে অনুমোদন করার জন্য চলতি মাসে প্রেসিডেন্টের জারি করা একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন ও সমুদ্রসংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে চুক্তি হলেও আলজেরিয়া সরকার এত দিন তা অনুমোদন করেনি। তাই প্রেসিডেন্ট চলতি মাসেই চুক্তিটি অনুমোদন করলেন। এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ কয়েক বছর বিলম্ব ঘটলেও আলজেরিয়ার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি। অবশ্য সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যেই হয়তো কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
এর আগে, শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে তিবোনির টেলিফোন সংলাপের পর তিবোনির অনুরোধে আঙ্কারা গত বছর পলাতক একজন আলজেরীয় সৈন্যকে আলজেরিয়ার কাছে হস্তান্তর করেছিল। ওই সৈন্যের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য ফাঁস করে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। দু’দেশের প্রেসিডেন্ট প্রায়ই ফোনালাপ করে থাকেন। গত জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোগান আলজেরিয়া সফর করেন। সে সময় তিনি আলজেরীয় কর্তৃপক্ষকে লিবিয়ায় তুরস্কের অপারেশনের কার্যক্রমে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আকাশপথ ব্যবহার এবং নৌঘাঁটিতে প্রবেশের সুযোগ প্রদানের জন্য বারবার আহ্বান জানান। দু’দেশের মধ্যে ২০০৩ সালে যে কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, সেটিকে পুনরায় সক্রিয় করার জন্য কাজ শুরু করেছে উভয়েই।
সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ভ‚রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অভিন্ন উদ্বেগের কারণে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি এখনো তুলনামূলকভাবে নতুন ঘটনা। যাই হোক না কেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে গত কয়েক বছর ধরে দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নে এগিয়ে না এলেও এখন তারা যে নতুন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে, তা যে ফুলশয্যার পথ নয় এবং এ ক্ষেত্রে যে বহু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে তা অস্বীকার করা যায় না। প্রথমত সম্পর্ক হবে বাস্তবতার আলোকে এবং অনিরপেক্ষ আঞ্চলিক পরিবেশের কারণে অস্থায়ীভাবে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে- তার ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত এখনো সিরিয়া, ন্যাটো এবং লিবিয়ার মতো কিছু বিষয় আছে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের স্বার্থ ভিন্ন। তৃতীয়ত আলজেরিয়ার অভ্যন্তরীণ রূপান্তর বা পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। ফলে আলজেরিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল ফ্রান্স-আলজেরিয়া সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে সে ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে একটি স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তুরস্কের কাছে আলজেরিয়া এখনো পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন চিন্তাভাবনার বিষয়। তাই একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ গতি-প্রকৃতি উপলব্ধি করার লক্ষ্যে দেশটির প্রত্যেক দলের সাথে সংলাপে বসা গুরুত্বপূর্ণ। আলজেরিয়ার একটি ইসলামপন্থী গ্রুপের প্রতি আঙ্কারার সমর্থনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি তুরস্ক ও আলজেরিয়ার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়া সত্তে¡ও উভয়পক্ষ বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক আলজেরিয়াকে বিশেষভাবে তার মাগরেব পলিসি তথা পশ্চিমমুখী নীতির দরজা বা প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করে। এই প্রবেশদ্বার দিয়ে তুরস্ক অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। তাই তুরস্ক দু’দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হোক- এমন কিছু চায় না।
সুতরাং তুরস্ক আলজেরিয়ার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই সম্পর্কোন্নয়নে ব্রতী হবে। উত্তর আফ্রিকার পরিবর্তিত ভ‚রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি এবং ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ আঙ্কারার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্ক তার স্বার্থকে নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক করার জন্য বিরোধপূর্ণ পশ্চিম সাহারা অঞ্চল নিয়ে আলজেরিয়া ও মরক্কোর মধ্যকার বিরোধের ব্যাপারে নমনীয় নীতি অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে মনে করে। তাই আঙ্কারা এ ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি কাঠামো তৈরি করে রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি দৃঢ়সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তারা এ ক্ষেত্রে সম্ভবত কোনো পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সময়ে লিবিয়া যখন অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে এবং মিসরও তুরস্কের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে- ঠিক এ সময়ে মাগরেব অঞ্চল তুরস্কের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে।
লেখক : তুরস্কের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
‘আরব নিউজ’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
Leave a Reply