1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৪:১৬ অপরাহ্ন

দেশের গন্তব্য কোন অভিমুখে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৫ জুলাই, ২০২৫

সংস্কারের প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু তারা শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে কোনো কমিশন যে গঠন করেনি, এ জন্য অবশ্যই প্রশংসা দাবি করতে পারে। আমাদের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা এমনিতেই নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। তার মধ্যে আবার সংস্কারের ধাক্কাধাক্কি সে-বেচারাকে নতুন জ্বালাতনের মধ্যে ফেলুক, এটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। অতীতে দেখা গেছে, যখনই কোনো ‘বৈপ্লবিক’ সরকারের আগমন ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই তারা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়ে এবং মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা একটা ধাক্কা খায়। পরবর্তী ‘বিপ্লবী’ সরকার আবার নতুন সংস্কারে হাত লাগিয়ে ব্যবস্থাকে আরেকটা ধাক্কা দেয়। মূল যে সংস্কার প্রয়োজন সেটা হলো, একটি অভিন্ন ব্যবস্থা চালু করা– রাষ্ট্রপরিচালকরা সে-ব্যাপারকে বিবেচনার মধ্যেই আনেন না। বৈষম্যনির্ভর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আগের মতোই সহাস্যে টিকে থাকে।

পতিত আওয়ামী সরকার সংস্কারের নামে কয়েকটি অতিরিক্ত পাবলিক পরীক্ষার সংযোজন ঘটিয়ে মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে তৎপর হয়েছিল। তাতে দুর্বল ব্যবস্থাটা আরও ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠায় তারা অতিরিক্ত পরীক্ষা রদ করেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যে তাদের নিজেদের প্রণীত বাংলা পাঠ্যপুস্তক থেকে আচমকা ১১টি কবিতা এবং ৫টি গল্প ও প্রবন্ধ বাদ দিয়ে দিল, সেই বৈপ্লবিক কাজটি কেন করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সেই সরকারের পতনের পর তাদের অনেক নৃশংসতা, অপকর্ম ও দুর্নীতির তদন্ত করা হচ্ছে এবং হতে থাকবে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্মম ও ক্ষতিকর হামলাটি কেন ঘটেছিল, সে-বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। তদন্ত হওয়াটা কিন্তু আবশ্যক। জানা দরকার শিক্ষার ওপর অমন হস্তক্ষেপটি কারা এবং কীভাবে ঘটিয়েছিল। কাজটা বর্তমান সরকার শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা জানার ব্যাপারেও সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

হেফাজতে ইসলামসহ ইসলাম ধর্মভিত্তিক বহু দলের তৎপরতা আছে। তাদের সমাবেশে লোকের কোনো অভাব ঘটে না। কারণ মাদ্রাসা, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার বর্তমান ও অতীতের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল এবং এখন তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। যে শিক্ষা এরা পেয়েছেন তা তাদেরকে উৎপাদনশীল কাজে তো নয়ই, এমনকি সাধারণ চাকরি-বাকরির জন্যও উপযুক্ত করে তোলেনি। দারিদ্র্য ও বেকারত্বের দুঃসহ চক্রের ভেতরেই তারা থাকেন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ডাক পড়লে ভালো কাজ পেয়েছেন বলে বিপুল সংখ্যায় এসে হাজির হন। সম্প্রতি এদের এক সমাবেশে উদারনীতিকদের তো বটেই, মেয়েদের বিরুদ্ধেও যে ভাষা-ভাব-ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা গেছে, তেমনটা স্বাধীন বাংলাদেশে কখনও শুনতে ও দেখতে হবে– ইতোপূর্বে কল্পনাও করা যায়নি। বিশেষ করে সেই উদ্যানে যার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং যেটি বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকারই একটি অংশ।

গ্রামাঞ্চলে এখন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শহরেই নেই, গ্রামে কেন আশা করব? নাটক নেই, গান নেই; মেলা উঠে গেছে; চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বাধাগ্রস্ত; আছে শুধু ওয়াজ। ওয়াজকে এখন বিনোদনের ব্যাপার করে তোলা হয়েছে। বক্তারা জাঁকজমকের সঙ্গে, অনেক সময় হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে আসেন। বক্তৃতা করেন, টাকা নিয়ে চলে যান। রেখে যান তাদের বক্তব্যের অশালীন অংশের রেশ। পুরুষরা আমোদ পান, মেয়েরাও মেনে নেন– এটাই স্বাভাবিক বলে। ওই ওয়াজই সেদিন ভিন্ন আঙ্গিকে চলে এসেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে; হেফাজতিদের সমাবেশে। সংস্কারের মহৎ উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গঠিত যে ১১টি কমিশন কাজ করছে, তাদের অন্য কোনোটির বিষয়েই সেই সমাবেশের বক্তারা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কেবল একটির ওপরে। সেটি হলো নারীর অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন। সেই কমিশন অবিলম্বে ভেঙে দিতে হবে বলে তারা হুঙ্কার দিয়েছেন। কমিশন অন্য কেউ গঠন করেনি; করেছে সরকার নিজে। সেই কমিশন ভেঙে দিতে হবে– এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দিক থেকে প্রতিবাদ প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ আমরা শুনিনি।

বর্তমান সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এবং সেই অভ্যুত্থানে মেয়েরা ছিলেন একেবারে সামনের কাতারে। আমাদের দেশের সকল আন্দোলনেই মেয়েরা থাকেন। কিন্তু চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তাদের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব, এমনকি অভাবিতপূর্বও বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বটেই, স্কুল-কলেজের মেয়েরাও পথে বের হয়ে এসেছেন। কেবল ঢাকায় নয়, প্রতিটি শহরে। মধ্যরাতে আবাসিক হল থেকে মেয়েদের রাজপথে এসে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল করা ও সমাবেশে যোগ দেওয়া আগে কখনও ঘটেনি। মেয়েরা লড়েছেন। সেবা-শুশ্রূষা এবং চিকিৎসাও করেছেন। সরকারি হিসাবে শহীদ হয়েছেন ১১ জন নারী; প্রাণ হারিয়েছে ১৩২ জন শিশু।

মেয়েদের এই অংশগ্রহণ অভ্যুত্থানকে একটি সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস বলেও অনেকে ভেবেছিলেন। কিন্তু দিনের শেষে যে কে সেই। থোড় বড়ি খাড়া। নারী নির্যাতন একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। স্বভাবতই এরা দৃষ্টান্ত মাত্র, ঘটনার বিস্তারের কোনো পরিমাপ নয়। একটি ঘটেছে পটুয়াখালীর কলেজছাত্রী লামিয়া আক্তারের জীবনে। অপরটির শিকার নরসিংদী সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিন। নাদিরা ‘নারী অঙ্গন’ নামে একটি সংগঠনের সম্পাদক এবং ‘হিস্যা’ নামে একটি পোর্টালেরও সম্পাদক। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সম্পত্তিতে নারীর সমান হিস্যার কথা বলেছেন। নরসিংদীর বাসিন্দা হেফাজতপন্থিদের সেটা সহ্য হবে কেন? তারা কলেজ থেকে নাদিরার প্রত্যাহার চেয়েছেন। কী অভিযোগ, কেন অভিযোগ, পেছনে কোনো অভিসন্ধি রয়েছে কিনা– সেসব বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। হেফাজতিদের দাবি মেনে নিয়ে তাঁকে সাতক্ষীরায় বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরায় বদলির কথা শুনে তিনি প্রমাদ গুনেছেন। কারণ তিনি শুনেছেন, সেখানে মৌলবাদীরা অত্যন্ত তৎপর। কিন্তু সাতক্ষীরা নিজেই যে তাঁকে পছন্দ করবে না, অতটা তিনি অনুমান করতে পারেননি। সাতক্ষীরার কতিপয় শিক্ষার্থী সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে এবং জেলা প্রশাসকের কাছেও স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন নাদিরা ইয়াসমিনকে যেন কলেজে যোগ দিতে না দেওয়া হয়। সুন্দর কথা বলেছেন জেলা প্রশাসক– অভিযোগের তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাদিরা ইয়াসমিনকে অবশ্য অতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। তদন্তের আগেই সাতক্ষীরা থেকে তাঁকে টাঙ্গাইলে বদলি করা হয়েছে। নাদিরা ইয়াসমিনের পক্ষে এখন কে দাঁড়াবে? প্রতিবাদ অবশ্য দু’চারটি সংগঠন থেকে করা হয়েছে। তবে সেসবের তেমন প্রচার নেই। প্রতিবাদকারীদের কণ্ঠে যে জোর আছে, তাও নয়। তা ছাড়া এখন কেই-বা শোনে ভালো মানুষের কথা? নাদিরাকে কি শেষ পর্যন্ত চাকরি হারাতে হবে? আমরা জানি না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com