করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে। গত ৬ সপ্তাহে মেডিক্যালে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালগুলোয় দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ১২০ মেট্রিক টনের মতো। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় চাহিদা বেড়ে হয়েছে ১৮০ মেট্রিক টন। অক্সিজেন চাহিদার পুরোটা বাংলাদেশ উৎপাদন করতে পারে না। এ অবস্থায় করোনা ব্যাপকভাবে আঘাত হানলে অক্সিজেন জোগান ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
সরকারি হাসপাতালগুলোয় যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার তার ৯০ শতাংশই সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি। বাকিটা সরবরাহ করে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড ও স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড। নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে দুটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট রয়েছে লিন্ডের। এগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয়। সব মিলিয়ে দেশে অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৭০ মেট্রিক টন। তবে নানা কারণে উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ ১৬০ মেট্রিক টন। বাকি ২০ মেট্রিক টন ভারত, চীন ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয়। কিন্তু ভারত থেকে আমদানি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আর চীন ও পাকিস্তান থেকে আমদানি সময়সাপেক্ষ।
বাংলাদেশের অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা, সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে। দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলা আর সেখানে নতুন স্ট্রেইনে অক্সিজেন সংকটের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। শত শত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে কেবল এ কারণে। এ অবস্থায় ভারত বিদেশ থেকে বিমানে করে উড়িয়ে এনেছে অক্সিজেন উৎপাদনকারী সরঞ্জাম।
বাংলাদেশে অক্সিজেন পরিস্থিতি কী, উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ কী পরিমাণ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, মজুদ পরিস্থিতি কী, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, এখনো অক্সিজেন সংকট নেই। তবে কোভিড বাড়তে থাকলে সংকট দেখা দিতে পারে। সরকারের সঙ্গে আমরা সবসময় যোগাযোগ রাখছি। প্রয়োজনে সর্বোচ্চ কতটুকু সরবরাহ করতে পারব, সেটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ।
সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইতোমধ্যে শিল্পজাত অক্সিজেনের চেয়ে মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আসলে এখন সরকারের সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে ভবিষ্যৎ বিবেচনায় দেশে উৎপাদন ও সরবরাহ সক্ষমতা বিবেচনা করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমরা যেহেতু এ খাতে ব্যবসা করে আসছি দীর্ঘদিন, সেক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা চাইলে তা দিতে প্রস্তুত।
ভারতেও লিন্ডের একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট রয়েছে। সেখান থেকেও অক্সিজেন এনে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে ভারতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২২ এপ্রিল থেকে অক্সিজেন সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। লিন্ডে ছাড়াও যেসব কোম্পানি ভারত থেকে অক্সিজেন আনত, তাদের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে।
লিন্ডে ছাড়াও স্পেকট্রা অক্সিজেন কোম্পানি অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। লিন্ডের পরপরই তাদের অক্সিজেন সরবরাহের অবস্থান। স্পেকট্রা অক্সিজেনের সিইও খলিলুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, স্পেকট্রা প্রতিদিন গড়ে ৩৭ টন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারছে। যদি চাহিদা বেড়ে যায় তখন কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অক্সিজেন এমন একটি বিষয় চাইলেই এর সরবরাহ রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়।
সবচেয়ে সহজ ছিল ভারত থেকে আমদানি করা। কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের সড়ক পথ ছিল। কিন্তু এখন সেটা বন্ধ। ফলে অক্সিজেন যদি দুবাই, চীন বা সিঙ্গাপুর থেকেও আনা হয়- সেটা সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ। একটা বড় ট্যাংকারে হয়তো ২০ টন অক্সিজেন আমদানি করা যাবে। কিন্তু সেটা আসতে সময় লাগবে এক মাস। এ অবস্থায় জরুরি অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করা কঠিন। তা ছাড়া চাইলেই অক্সিজেন পরিবহনে বড় ট্যাংকার পাওয়া সহজ নয়। কারণ এসব ট্যাংকার সবসময়ই কম। এখন সরকারের উচিত হবে পূর্বানুমান করে চাহিদা নির্ধারণ। জরুরি অক্সিজেন সরবরাহ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ আগে থেকেই নিয়ে রাখা। ইসলাম অক্সিজেনও দেশে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। সূত্রে জানা যায়, তাদের উৎপাদন সক্ষমতা প্রতিদিন প্রায় ৪০ টন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেওয়ার আগেই পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করা দরকার। ভারতের মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, এ জন্য পরিকল্পনামাফিক কিছু কাজ করতে হবে। রোগী বিবেচনায় নিয়ে অনুমাননির্ভর চাহিদা নির্ধারণ করে ঘাটতি নির্দিষ্ট করতে হবে। এরপর সরবরাহ নিশ্চিত করতে যারা অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ করে- তাদেরকে শিল্পের অক্সিজেন থেকে মেডিক্যাল অক্সিজেন সরবরাহ করতে বলতে হবে। এখানেও তাদের কত ক্ষতি হবে এবং কতটুকু চাহিদা পূরণ হবে, তা নির্ণয় করতে হবে।
দেখা গেছে, তীব্র সংকটে দিশেহারা ভারত বিদেশ থেকে অক্সিজেন আনছে বিমানে করে। রোগী বাড়লে অক্সিজেন সংকট সামাল দেওয়া নিয়ে চিন্তিত সরকারও। ২২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেশের অক্সিজেনের চাহিদা এবং সরবরাহ বিষয়ে একটি সভা হয়। সেখানেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।ভারত থেকে অক্সিজেন আসে মূলত যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে। সেখান দিয়ে ২১ এপ্রিলের পর কোনো গাড়ি ঢোকেনি বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তা ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এনসিডিসি) অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, ভারতের অক্সিজেন সংকটের বিষয়টি নজরে এসেছে। দেশে অক্সিজেনের সংকট হলে তা মোকাবিলার জন্য দেশীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও হাসপাতাল শাখার পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিটিং করেছেন।
চট্টগ্রামের আবুল খায়ের গ্রুপ, বিএসআরএমসহ ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান শিল্পকারখানার জন্য অক্সিজেন উৎপাদন করে। এসব কোম্পানির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে দেশে অক্সিজেন সংকট হলে উৎপাদিত অক্সিজেন শিল্পকারখানায় ব্যবহার না করে মেডিক্যালে ব্যবহার করার বিষয়ে। আশা করছি, যে কয়েকটি কোম্পানি আছে তাদের অক্সিজেন উৎপাদনের যে ক্ষমতা আছে, সেগুলো মেডিক্যালে ব্যবহার করা হলে কোনো সমস্যা হবে না। এই মুহূর্তে অক্সিজেন আমদানি করার কথা ভাবছি না। প্রয়োজন হলে দেশীয় কোম্পানির উৎপাদিত অক্সিজেন দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেওয়ার আগেই পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করা দরকার। ভারতের মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, এ জন্য পরিকল্পনামাফিক কিছু কাজ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, অক্সিজেনের ঘাটতি থাকায় দুটি প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করত। এখন তা বন্ধ রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদন করতে বলা হবে।
Leave a Reply