২০২১ সালে ভারত যখন আফগানিস্তান থেকে তাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে নিল, তখন খুব কম বিশেষজ্ঞই ভেবেছিলেন যে তালেবান কাবুলের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুই দেশের সম্পর্ক কখনো আবার চালু হবে।
নব্বই দশক থেকেই আফগান তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বৈরী ছিল। এর মূল কারণ ছিল তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের প্রথম তালেবান শাসনামলে ভারত আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ ও আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বাধীন ‘নর্দান অ্যালায়েন্সকে’ সমর্থন দিয়েছিল তালেবান উৎখাতে।
পরে ২০০১–২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি ছিল। সেই সময় ভারত তাদের তালেবানবিরোধী নীতিকে আরও শক্ত করে তোলে। ফলে কাবুল ও নয়াদিল্লির দূরত্ব আরও বাড়ে। এই সময়জুড়ে ভারত তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে চিহ্নিত করত। তাদের কোনো রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিত না। এমনকি যখন আমেরিকা দোহায় তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল, তখনও ভারত যে কোনো ধরনের শান্তি আলোচনার ধারণারই বিরোধিতা করেছিল।
২০২০ সালের দোহা চুক্তির পর বিশ্লেষকেরা মনে করেছিলেন যে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারত প্রভাব হারিয়েছে। তালেবান কাবুল দখলের আগে ভারত তার দূতাবাস ফেলে পালিয়ে আসে। যদিও ২০২২ সালে কিছু প্রাথমিক পর্যায়ের কূটনৈতিক কার্যক্রম আবার শুরু হয়। যেমন মানবিক সহায়তা পাঠানো। তবুও ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় মেয়াদের তালেবান নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামিক আমিরাত’-এর সম্পর্ক উন্নতির সম্ভাবনা তখনও দুরাশাই মনে হচ্ছিল। আদর্শগত ব্যবধান ও অতীতের তিক্ততা ছাড়াও পাকিস্তানের ভৌগোলিক উপস্থিতি ছিল এই দুই পক্ষের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রাচীর।
কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে দৃশ্যপট পাল্টেছে। এখন পাকিস্তান এক সংকটময় অবস্থায় আছে। তার দুই পাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বৈরিতা বাড়ছে।
গত জানুয়ারিতে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ও আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুততাকির মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। বোঝা যাচ্ছে যে ভারত এখন পাকিস্তানের আফগান নীতির দুর্বলতার সুযোগ নিতে প্রস্তুত। এর আগে ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান বিভাগের যুগ্ম সচিব জে পি সিং প্রথমবারের মতো কাবুলে আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ইয়াকুব হচ্ছেন তালেবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের পুত্র।
পাকিস্তানের সাবেক আফগান রাষ্ট্রদূত মনসুর আহমদ খান ডন পত্রিকাকে বলেন, ‘আফগানিস্তান-ভারত সংযোগ নিয়ে পাকিস্তানের বিচলিত হওয়া উচিত নয়। … পাকিস্তানের উচিত আফগানিস্তানের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে প্রতিবেশী দুই দেশের স্বাভাবিক মৈত্রী বজায় থাকে।’
কিন্তু বাস্তবে এটি সহজ কাজ নয়। আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের সঙ্গে পাকিস্তানের আগের সখ্য কমে এসেছে। খাইবার পাখতুনখাওয়ার মাদ্রাসার সঙ্গে তালেবান নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিন্তু তবু ২০২১ সালের ১৫ আগস্টের পর পাকিস্তান কাবুলের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বিলাওয়াল ভুট্টো আফগান তালেবানকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরেও পাকিস্তানের জাতিসংঘ দূত মুনির আকরাম জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বলেছিলেন যে আফগানিস্তানের সমস্যার সমাধান সংলাপ ও যৌথ ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব।
কিন্তু এখানেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ডুরান্ড রেখা বরাবর সীমান্ত সংঘর্ষ, অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা, টোরখাম ও চামান সীমান্তে দিনের পর দিন অচলাবস্থা—এসব ঘটনা পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের সম্পর্কে গভীর অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। আফগানিস্তানের অধিকাংশ স্থল বাণিজ্য ও সমুদ্রবন্দর নির্ভর করে পাকিস্তানের ওপর। তাই সীমান্ত বন্ধ হলে কাবুলের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়।
তার ওপর যুক্ত হয়েছে আশ্রয়প্রার্থী সমস্যা। ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রায় পাঁচ লাখ ‘অবৈধ’ আফগান শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় আরও প্রায় ১০ লাখ মানুষকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত আফগান প্রশাসন এই চাপ নিতে মোটেও প্রস্তুত নয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের আকাশপথ থেকে আফগানিস্তানের ওপর বিমান হামলা। গত তিন বছরে পাকিস্তান দুবার তালেবানপন্থী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-র ঘাঁটিতে হামলা চালায়। আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের চেষ্টা চলাকালেই এমন হামলা হয়েছে, ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলাফল নেতিবাচক হয়েছে।
এত সব উত্তেজনার ফলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংলাপ প্রায় বন্ধ। সীমান্ত সন্ত্রাসবাদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনার কোনো কার্যকর উপায় নেই। ফলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর তালেবান সরকার পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতা কমাতে অন্য বন্ধু খুঁজছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারত তার হারানো অবস্থান আবার ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছে। মানবিক সহায়তা, পুনর্গঠন প্রকল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছত্রছায়ায় ভারত চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে নতুন করে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের। টিটিপি ও বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মতো পাকিস্তানবিরোধী শক্তিগুলোকে সাহায্য করার ক্ষেত্রেও ভারত পিছু হটবে না বলেই মনে হয়।
এ ছাড়া ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং ভারতের চীন-বিরোধিতা, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ ও চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের (সিপেক) সম্প্রসারণে বাধা দেওয়া ভারতের উদ্দেশ্য হতে পারে। আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিপেকের স্বপ্নকেও ভারত বিঘ্নিত করতে চাইবে।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, মিশ্রি-মুততাকি বৈঠক এখনই খুব বড় আতঙ্কের বিষয় নয়। বরং পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সম্পর্কে যদি এমন টানাপোড়েন চলতে থাকে, সেটাই বেশি উদ্বেগের কারণ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক চাপ, সীমান্ত বন্ধ, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও আকাশপথ হামলা—এসব দ্বিপক্ষীয় আস্থার সংকট বাড়াচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক আফগান বিশ্লেষক উবায়দুল্লাহ বুরহানির মতে, আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জটিল সম্পর্কগুলোর একটি। ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক যোগসূত্রের কারণে এ দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সহযোগিতা ও উত্তেজনা পাশাপাশি চলে আসছে। পাকিস্তান আফগানিস্তানে তালেবানকে সমর্থন দিয়ে নিজের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেছে। তবে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ আস্থা ধ্বংস করেছে।
ফলে আফগানিস্তান এখন ভারত ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে নিজস্ব নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছে। ভারতেরও লক্ষ্য, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের প্রভাব কমানো ও দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়ানো।
পাকিস্তান-ভারত সাম্প্রতিক উত্তেজনার বিষয়ে আফগানিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষ নেয়নি। তবে নানা ইঙ্গিত থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, কাবুল নীরবে ভারতের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল অবস্থান নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন অনেক আফগান।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ডুরান্ড রেখা ঘিরে পাকিস্তানের সীমান্ত নীতি ও সামরিক পদক্ষেপে তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে গভীর ক্ষোভ জমেছে। পাশাপাশি কয়েকজন আফগান ব্যক্তিত্ব পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের সমালোচনা করে ইঙ্গিত দিয়েছেন, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের নাক গলানোর কারণে প্রতিবেশী হিসেবে তাদের বিশ্বাস করা যায় না। তাই উত্তেজনা আরও বাড়ার শঙ্কায় কাবুল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নীরব থাকলেও, আফগান জনমত ও নেতৃত্বের মধ্যে ভারতের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আফগানিস্তানে ভারতের নতুন তৎপরতা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও এক নতুন পরীক্ষা। পাকিস্তানের কূটনৈতিক ভুলগুলোর সুযোগ নিয়ে ভারত যদি তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারে, তাহলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বড় ধরনের পালাবদল ঘটতে পারে।
ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
Leave a Reply