‘তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না, এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’
প্রেমিকা নার্গিসকে লেখা প্রথম ও শেষ চিঠিতে এভাবেই প্রেমানুভূতি প্রকাশ করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কবিতীর্থ দৌলতপুরের নার্গিসই ছিলেন নজরুলের প্রথম প্রেয়সী-কবির প্রেমকাননের প্রথম ফুল, যে ফুল ঝরে যায় অপ্রত্যাশিত দ্রুততায়। এদিকে অযত্ন-অবহেলায় কবির প্রথম প্রেমের সব স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট হচ্ছে। দৌলতপুরে কবির স্মৃতিবিজড়িত বন্ধু আলী আকবর খানের বাড়িটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবে এবার ২৬ মে দৌলতপুরে জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে কবি ভক্তদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে।
জানা গেছে, ১৯২১ সালের এপ্রিলে প্রথম কুমিল্লা রেলস্টেশনে নামেন নজরুল। এরপর তিনি বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা নগরের বীরেন সেনের বাসায় ছিলেন ৪-৫ দিন। সেখান থেকে মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে যান। সেখানে আলী আকবর খানের বাড়ির পুকুরে সাঁতার কেটে, পলো দিয়ে মাছ ধরে, জ্যোৎস্না রাতে পুকুরপাড়ের আমগাছের নিচে বাঁশি বাজিয়ে সময় কাটিয়েছেন কবি। এখানকার সবুজ-শ্যামল পরিবেশ কবিকে দারুণভাবে পুলকিত করে। এখানে বসে কবি রচনা করেছেন বহু কবিতা, গান ও ছড়া। তিনি ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন। ‘পাঁপড়ি-খোলা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন এখানে বসেই। এছাড়াও ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’, ‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ কবিতাগুলো লিখেছিলেন। কবি দৌলতপুর ও কুমিল্লা নিয়ে বাংলা গান ও কবিতার চারটি বই প্রকাশ করেন। এগুলো হলো ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পুবের হাওয়া’ ও ‘ঝিঙেফুল’।
দৌলতপুরে অবস্থানকালে কবি গ্রামের ছেলেদের গান শেখাতেন। মেয়েদের শেখাতেন নাচ। কবি নিজে খাঁ বাড়ির পুকুরের শান্ত পানিতে গোসল করতেন। সাঁতার কাটতেন। একডুবে পুকুরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে যেতেন।
দৌলতপুরে কবি নজরুলের সঙ্গে আলী আকবর খানের বড় বোন আসমাতুন নেসার মেয়ে সৈয়দা খাতুনের পরিচয় হয়। তখন নজরুলের বয়স ২২, সৈয়দা খাতুনের ১৬। কবি সৈয়দা খাতুনের নাম দেন নার্গিস। তার হাতেই নজরুলের প্রেমের হাতেখড়ি।
আলী আকবর খানের মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুরের বাড়িতে একটি ঘরে থাকতেন নজরুল। এ ঘরটির ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল। বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন। এই বাড়িতে থাকার সুবাদে আলী আকবর খানের ভাগনি পাশের বাড়ির নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
দৌলতপুরের এই বাড়িতে দুটি বড় আমগাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। নজরুল একটি আমগাছের তলায় দুপুরে শীতলপাটিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। এই আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙ্গা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি। এখানে কবি খাঁ বাড়ি ও গ্রামের ছেলেময়েদের নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে আমগাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন।
জানা যায়, কবি ও আলী আকবর খান যখন বিকালে একসঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে শীতলপাটি বিছিয়ে কবিতা ও গান রচনা করতেন, রূপসী নার্গিস তখন নানা কাজের ছলে ছুটে আসতেন সেখানে। চোখের ভাষায় কথা হতো দুজনার। ১৯২১ সালের ১৮ জুন নজরুল ও নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়। যেই ঘরে তাদের বাসর হয় সেটি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটচালা ছিল। বর্তমানে চারদিকে বেড়া আর টিনের ছাউনিতে রূপান্তরিত হলেও আয়তনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। নজরুল ও নার্গিসের বাসরে ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক, বিছানা, ২টি বালিশ, কম্বল ও কাঠের সিন্দুক এখনো আছে। তবে যথাযথ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ না করায় সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কবির অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত আলী আকবর খানের বাড়িটির পলেস্তারা খসে পড়ে যাচ্ছে। সরকারি ভাবে উদ্যোগ নেওয়া না হলে কবির এসব স্মৃতিচিহ্ন অচিরেই মুছে যাবে বলে দাবি স্থানীয় নজরুল ভক্তদের।
জানা যায়, বাসররাতে কবি নার্গিসকে একটি কবিতা উপহার দেন। তিনি লিখেছিলেন-
‘ব্যর্থ মোদের গোধূলি-লগন এই সেই জনমে নহে,
বাসর শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির বিরহের।
কত সে লোকের কত নদী
পারায়ে চলেছি মোর নিরবধি।
মোদের মাঝারে শত জনমে শত সে জলধি বহে,
বারে-বারে ডুবি, বারে-বারে উঠি জন্ম মৃত্যু দহে।’
কিন্তু বিয়ের রাতেই বাসরঘর থেকে নজরুল বের হয়ে যান নার্গিসকে একা ফেলে। ওই রাতেই নজরুল অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে হেঁটে মুরাদনগরের দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় নজরুল এভিনিউ রোডের বাড়িতে আসেন। এরপর তিনি কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। দৌলতপুর ত্যাগ করার সময় নজরুল লিখে গেছেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’
সত্যিই নজরুল আর কখনো দৌলতপুরে না ফিরলেও নজরুলের স্মৃতি এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন দৌলতপুরবাসী। নজরুলকে ভুলতে পারেননি এ জনপদের মানুষ। দৌলতপুরে কবি নজরুলের ৪টি স্মৃতিফলক রয়েছে। কান্দিরপাড় এসে নজরুল তার মামাশ্বশুর আলী আকবর খানকে চিঠিতে লেখেন, ‘আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতোন ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে তা সকলে ক্ষমা করবেন।’
এদিকে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নার্গিস-নজরুল বিদ্যানিকেতন’ নামের একটি বিদ্যালয়। এখানে সংগীত, নৃত্য, নাটক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাঠাগারের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নজরুল নিকেতন পাঠাগার’। দৌলতপুরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’। ‘খাঁ’ বাড়িতে ঢোকার পথে স্থাপন করা হয়েছে ‘নজরুল তোরণ’। মুরাদনগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে ‘কবি নজরুল মিলনায়তন’।
নার্গিস-নজরুল বিদ্যা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, দৌলতপুরে কবি নজরুলের অনেক স্মৃতি রয়েছে। এখানে নজরুল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেছেন। নজরুলের স্মৃতিকে ধরে রেখে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কবির সাহিত্য, গল্প ও সংগীত তুলে ধরার জন্য এ বিদ্যা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, দৌলতপুর গ্রামকে কবিতীর্থ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
নার্গিস বংশের উত্তরসূরি বাবলু আলী খান বলেন, দৌলতপুরে এবারই প্রথম সরকারি উদ্যোগে নজরুলের জন্মবার্ষিকী পালনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২৬ মে এখানে অনুষ্ঠান করা হবে। তিনি বলেন, কবির প্রতিটি স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে নার্গিস ও নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে এখানে সরকারিভাবে বেশকিছু উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে এক সময় এগুলো হারিয়ে যাবে। কবির স্মৃতি সংরক্ষণে একটি জাদুঘর স্থাপন করা জরুরি।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, দৌলতপুরে জাতীয় কবির সব স্মৃতি সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
Leave a Reply