করোনা ভাইরাস মহামারীতে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় অক্সিজেন হয়ে উঠেছে অতিজরুরি এক অস্ত্র। প্রতিবেশী দেশ ভারতের অক্সিজেনের অভাবে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মাত্র ক’দিন আগে বাংলাদেশেও অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার তৈরি হয়েছিল। সেই জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন নিয়ে একশ্রেণির প্রতারক ও অসাধু ব্যবসায়ী টাকার খেলায় মেতেছেন।
তারা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চার থেকে পাঁচগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন একেকটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম। অথচ এসব সিলিন্ডারের অধিকাংশেই ঠাসা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেনে। যা সিলিন্ডার টেম্পারিং করে ক্রসফিলিংয়ের মাধ্যমে করা হচ্ছে রি-ফুয়েল।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন নিয়ে ক্রসফিলিংয়ের মাধ্যমে মেডিক্যাল গ্রেডের সিলিন্ডারে তা ভরে বিক্রি করছে উচ্চমূল্যে। এমনকি এই চক্র বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলিং এবং সিলিন্ডার সরবরাহের আগেই তা গোপনে টেম্পারিং করছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কিনে পুরনো মেয়াদকালের ওপর লোহার প্রলেপ বসিয়ে তাতে খোদাই করে ইচ্ছেমতো নতুন মেয়াদকাল বসিয়ে তা সরবরাহ করছে তারা। আবার অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি ও মজুদের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র গ্রহণের যে বাধ্যবাধককতা রয়েছে তারও তোয়াক্কা করছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। উল্টো লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলো কেনাবেচার রশিদ সংরক্ষণ না করে নকল প্যাডে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে খুচরা বাজারে মানহীন এসব অক্সিজেন সিলিন্ডার কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি ও বিতরণ করছে প্রকাশ্যে।
জানা গেছে, সম্প্রতি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানী ও কাছের কয়েকটি জেলায় আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ অক্সিজেন। এসব অসাধু চক্রের একটি বড় অংশ ঘাঁটি গেড়েছে রাজধানীর পল্লবী, তেজগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায়। মেডিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে এতে তারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন রি-ফুয়েল করছে। অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠানে মেয়াদোত্তীর্ণ অক্সিজেনও রিফিল করে বিক্রি হচ্ছে মেডিক্যাল গ্রেডে। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে একাধিক নকল অক্সিজেন তৈরি ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য।
পল্লবী থানাধীন মিরপুর-১১ নম্বর এলাকায় অবস্থিত মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ অধ্যক্ষের অফিস সহকারী আব্দুল আজিজ জানান, তার এক নিকটাত্মীয় স্বপরিবারে ২৬ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হন। মিরপুর বি-ব্লকের বাসায় তারা সবাই ছিলেন আইস্যুলেশনে। এ সময় পরিবারটির পাঁচ সদস্যের প্রত্যেকেরই ছিল শ্বাসকষ্ট। রাত-বিরাতে রোগীর কখন কী হয় এই শঙ্কায় ১৫ দিন আগে মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অদূরেই ১৬ নম্বর ভবনের নিচতলায় অবস্থিত অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স হানিফ এন্টারপ্রাইজ থেকে ১৫ হাজার টাকায় একটি মাঝারি সাইজের মেডিক্যাল গ্যাস সিলিন্ডার কিনে বাসায় নিয়ে যান ওই আত্মীয়।
কিন্তু ব্যবহারবিধি না জানার কারণে সিলিন্ডারটি ব্যবহার করতে না পারার কারণে এ যাত্রায় রক্ষা পান ওই করোনা রোগীরা। কারণ অক্সিজেন বিক্রির অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স হানিফ এন্টারপ্রাইজ থেকে আনা ওই মেডিক্যাল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ প্রতিষ্ঠানটির দোকান ও গোডাউনে মজুদ প্রায় ২০০ সিলিন্ডারের সবই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। সস্তায় মেডিক্যাল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাস্টমার সেঁজে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথা হয় দোকানটির একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে।
কথায় কথায় তারা জানান, সেখানকার সব সিলিন্ডারই মেয়াদোত্তীর্ণ। রাতের আঁধারে এসব সিলিন্ডারের মেয়াদকাল টেম্পারিং করে এতে তারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন রি-ফুয়েল করেছেন। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ভাঙাড়ি হিসেবে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারগুলো কিনে তাতে এই গ্যাস ভরে চড়ামূল্যে বিক্রি করছেন দোকান মালিক। বেসরকারি কোন কোন হাসপাতালে এসব নকল অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় জানতে চাইলে এ বিষয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে এড়িয়ে যান তারা।
সেদিন রাত সোয়া ১১টার দিকে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. হানিফের সঙ্গে। কর্মচারীদের বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অক্সিজেন বলুন আর লোহার সিলিন্ডারই বলুন, এগুলার মেয়াদ কখনোই শেষ হয় না। মহল্লার মধ্যে দোকান, এগুলো (সিলিন্ডার) বেচতে ওষুধ প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিবে কে?’ কথা প্রসঙ্গে প্রশ্ন আসে মেডিক্যাল অক্সিজেন কী? উল্টো প্রশ্ন রেখে তিনি জানান, তারাবো, তেজগাঁওয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন নিয়ে মেডিক্যাল গ্রেডের সিলিন্ডারে ক্রসফিলিংয়ের মাধ্যমে তা ভরে বিক্রি ও সরবরাহ করছেন তারা। সিলিন্ডার টেম্পারিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে একপর্যায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
মেসার্স হানিফ এন্টারপ্রাইজের অদূরেই মিরপুর-১০ নম্বর সেক্টরের ‘এ’ ব্লকের ১১ নম্বর লেনে অবস্থিত মাকসুদের বাসার (কালো পানির ট্যাংকসংলগ্ন রিলিফ ক্যাম্প) একাধিক গোডাউনে দেখা গেছে মজুদ করা অন্তত ২০০টি সিলিন্ডার। সেখানে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানেও হানিফ এন্টারপ্রাইজের মতো একইভাবে করোনা রোগীর জীবন নিয়ে নির্মম খেলা করছে গোডাউন কর্তৃপক্ষ। দুই মাস আগে এই গোডাউন ভাড়া নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক জানান, করোনাকালে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে খোলাবাজারে মেডিক্যাল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন বিক্রি হচ্ছে এটি খুবই উদ্বেগজনক তথ্য। কোনোভাবেই এটি করতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
মেডিক্যাল গ্রেডের অক্সিজেনের পরিবর্তে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীর চিকিৎসায় কোনো কাজে আসছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া মেডিক্যাল গ্রেডের অক্সিজেনের অযৌক্তিক এবং অতিরিক্ত ব্যবহারে রোগীর চোখের লেন্স ও ফুসফুসসহ শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ক্রসফিলিং বা টেম্পারিং করা সিলিন্ডার বাসাবাড়িতে মজুদ করলে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনাও রয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার কোথা থেকে আমদানি করা হচ্ছে বা এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা তা যাচাই ছাড়াই বাজারজাত করা দণ্ডনীয় অপরাধ। মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণাকারী এসব চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারির বিষয়ে জোর দেন তিনি।
Leave a Reply