বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনসমষ্টির চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছে সোয়া লাখের মতো বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসক। রয়েছে ১১৫টি মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন হাসপাতাল। রয়েছে উপজেলাকেন্দ্রিক চিকিৎসাকেন্দ্র। এর সাথে রয়েছে ১৫ সহস্রাধিক কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ সরবরাহের জন্য রয়েছে অনুমোদিত এক লাখ সাত হাজার ওষুধের দোকান। একই সাথে রয়েছে অননুমোদিত সম সংখ্যক ওষুধের দোকান। সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র, পল্লী চিকিৎসকের ওষুধের দোকান মিলিয়ে এ দেশে বছরে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক লেনদেন হয়। ২০২২ সালে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ১.৯ শতাংশ।
এখনো পুরো জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ তাদের চিকিৎসার জন্য স্বল্পশিক্ষিত পল্লী চিকিৎসক ও গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওষুধের দোকানের ওপর নির্ভরশীল। এসব ওষুধের দোকান কোনোরকম নীতিমালা ছাড়াই চলছে এবং এসব দোকানে ওষুধ কেনাবেচার ক্ষেত্রে কোনোরকম আইন-কানুনের বালাই নেই। শিক্ষিত ফার্মাসিস্টের অভাবে এসব দোকানে যেকোনো ওষুধ যেকোনো অবস্থায় যেকোনো সময়ে চিকিৎসকের কোনো ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কিনতে পাওয়া যায়। অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, ব্যথানাশক থেকে শুরু করে এমন কোনো ওষুধ নেই যা এসব দোকানে পাওয়া যায় না। সঠিক তাপমাত্রার কোনো বালাই নেই এসব দোকানে। এসব দোকানের বেশির ভাগই স্থানীয় চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রের আশপাশে অথবা হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে। এসব দোকানমালিক বা কর্মচারীর ৪৯ শতাংশের ওষুধ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। খুব কম দোকানদার ওষুধ রেজিস্টার রাখেন। ওষুধ বিক্রয়ের নীতিমালা, দোকানের অনুমতিপত্র, ওষুধ ক্রয়ের নীতিমালা, ওষুধ সংরক্ষণের নিয়ম- এ ব্যাপারে তাদের ধারণা সীমিত। ওষুধের মান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষিত হয় না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রসহ ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রয় সম্পর্কে তাদের বেশির ভাগেরই কোনো ধারণা নেই। ফলে প্রয়োজনহীন ওষুধ, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ, ভেজাল ওষুধ, মেয়াদবিহীন ও নিম্নমানের ওষুধ কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই বিক্রি হয়। অথচ ওষুধের ব্যবসার জন্য ‘সি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্ট ব্যতিরেকে কারো ওষুধের দোকান দেয়ার বিধান নেই।
বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতি, ওষুধ প্রশাসন যৌথভাবে তিন মাসের একটি কোর্স পরিচালনা করার পর ‘সি’ গ্রেড ফার্মাসিস্টের সনদ দেয়ার কথা থাকলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। ওষুধের সম্যক ধারণা না থাকায় এসব দোকানদার বা কর্মচারীকে বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।
শুধু ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এসব দোকান পরিচালিত হওয়ার ফলে ওষুধের দোকানের পরিবেশ সঠিকভাবে রক্ষিত হয় না। বেশির ভাগ দোকানে এ অবস্থা। ব্যতিক্রম মডেল ফার্মেসি ও প্রথম শ্রেণীর ফার্মেসিগুলো। শহরের অলি-গলিতে ও গ্রামে-গঞ্জে গড়ে ওঠা ওষুধের দোকানে প্রায়ই পরিবেশ এবং মান রক্ষা করা হয় না। এসব দোকানে অপ্রয়োজনীয় মানহীন ওষুধের ছড়াছড়ি। অনেক ক্ষেত্রে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের কথাও শোনা যায়। বিভিন্ন সময়ে খবরের কাগজের শিরোনামে এ খবরগুলো আসে। Over the counter (OTC)- ওষুধের খবর এরা রাখে না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এসব দোকানে অহরহ বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড-জাতীয় স্পর্শকাতর ওষুধ বিক্রয় হয়। এ ধরনের ওষুধ যথেচ্ছ বিক্রয় ও ব্যবহারের ফলে কিডনির বিভিন্ন ধরনের অসুখ, লিভার ও পাকস্থলীর বিভিন্ন অসুস্থতা বেড়েই চলছে। অনেকসময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জীবন সঙ্কটাপন্ন হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এসব অসুখের চিকিৎসাব্যয়ের কারণে অনেক পরিবারই সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওষুধের দোকানদার অথবা তার কর্মচারীকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে জোরদার করা দরকার। প্রয়োজনে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাথে সাথে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে নিয়মিত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী ওষুধের দোকান পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা দরকার ও নিয়মিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ খাওয়ার কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যম, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়, প্যাগোডায়, স্কুলে-কলেজে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের র্যালি, প্রতিযোগিতা- এসবের আয়োজন করা যেতে পারে। বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া ওষুধ ব্যবসায় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের ব্যবসায় যেকোনো মূল্যে ঠেকানো প্রয়োজন। নইলে গোটা জাতীয় স্বাস্থ্যই হুমকিতে পড়বে।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Leave a Reply