ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের মূল্যায়ন ‘হিজাব (পর্দা) ইসলামে অবশ্য পালনীয় কোনো অনুষঙ্গ নয়।’ সুতরাং ভারতীয় সংবিধানের ২৫-১ ধারায় প্রদত্ত অধিকার বা রক্ষাকবচ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এটি সর্বজনবিদিত যে, মুসলমানদের ধর্মাচারে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গগুলো শ্রুতি বা লেকচার নয় বরং কুরআন পাক ও হাদিসের নির্দেশনার আলোকে নির্ধারিত, যেমন নামাজ, রোজা, হজ, পর্দা ইত্যাদি। আদালত নামাজ, রোজার মতো ধর্মাচারগুলোকে অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ বিবেচনা করলে হিজাব বা পর্দার ক্ষেত্রে একই কুরআনের নির্দেশনা অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ না হয়ে যায় কেমন করে? সম্ভবত আদালত লক্ষ করে থাকবেন, বহু মুসলিম নারীই তো হিজাব পালন করেন না। হ্যাঁ, নামাজ-রোজার ক্ষেত্রেও একই কথা কম-বেশি প্রযোজ্য। একই রকম শৈথিল্য সব ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যেই দেখা যায়। কোনো একটি ধর্মাচার অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ হওয়ার জন্য শত ভাগ ধর্মানুসারী কর্তৃক প্রতিপালিত হওয়া অবশ্যই কোনো শর্ত নয়। বরং শর্ত হলো, এটি মূল ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত কি না।
প্রাসঙ্গিকভাবেই পর্দা বা হিজাব সম্পর্কে আল কুরআনের নির্দেশনা এখানে আলোচনার দাবি রাখে।
কুরআনের বাণী। ১. হে নবী! তুমি তোমাদের স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও বিশ্বাসী নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের চাদরের (ওড়নার) কিয়দংশ নিজেদের মুখের ওপর টেনে দেয়, এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের কেউ উত্ত্যক্ত (ইভটিজিং) করবে না।’ সূরা আহজাব-৫৯।
২. বিশ্বাসী পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য সর্বোত্তম, ওরা যা করে আল্লাহ তা জানেন। বিশ্বাসী নারীদেরকেও বলো তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। তাদের ঘাড়-বুক যেন মাথার কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে।’ (সূরা নূর: ৩০)।
(গ) বৃদ্ধা নারীরা যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের কোনো অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্য ছাড়া তাদের বহির্বাস (চাদর-বোরকা-হিজাব ইত্যাদি) খুলে রাখে, তবে এর থেকে তাদের বিরত থাকাই তাদের জন্য ভালো। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন।’ (সূরা নূর :৬০)।
(ঘ) ‘তিনি জানেন চোখের চুরিকে, আর যা অন্তরে লুকিয়ে থাকে।’(সূরা মুমিন : ১৯)।
(ঙ) স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোশাকস্বরূপ।’ (সূরা বাকারা : ১৮৭)।
এর পরও ‘হিজাব ইসলামে অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ নয়’ এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বিজ্ঞ আদালতের জন্য উদ্ধৃত আয়াতগুলো আল-কুরআনের নয়, প্রমাণ করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তা কী সম্ভব? ধর্ম বিষয় কোনো ফতোয়া দেয়া আদালতের কাজ নয়। যেমন মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেয়া। সন্দেহমুক্ত ফয়সালার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের ফতোয়া বা সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও তা বিচার্য হয়নি। তাই গত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে কুরআনের এসব নির্দেশ হিজাব সম্পর্কিত হওয়ার বিষয় বা এর দ্বারা হিজাব বাধ্যতামূলক হওয়ার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করেছেন এমন নজির একটিও নেই। এখন আদালত কি বলবেন যে, কুরআনের বক্তব্য তারা উপলব্ধি করতেই সক্ষম হননি যেমনটি হয়েছেন বিজ্ঞ আদালত?
এখন প্রশ্ন, ‘বাবরী মসজিদ বনাম রামের জন্মস্থান’ মামলার ক্ষেত্রে একই আদালতের ভিন্ন অবস্থান দৃশ্যমান কেন? বেদ পুরান উপনিষদের মতো ধর্মগ্রন্থগুলোতে রামচন্দ্র বা তাঁর জন্মস্থান নির্ণায়ক একটি শব্দ মাত্র খুঁজে পাওয়া না গেলেও ঠিক বাবরী মসজিদের স্থানটিতেই রামচন্দ্রের জন্মগ্রহণের মতো বিষয়টি হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের অংশই শুধু হলো না, বরং এর ভিত্তিতে ৪০০ বছরের মালিকানাও হাত বদল হয়ে গেল। রামচন্দ্র নামের কোনো মহাপুরুষের জন্ম ঠিক বাবরী মসজিদের স্থানটিতেই হয়েছিল কি না এ বিষয়ে নানা মত ও বিশ্বাসের মুকাবিলায় পর্দাসংক্রান্ত নির্দেশনাগুলো এতে পড়ে চাক্ষুস ও শতভাগ প্রমাণিত হওয়ার পরও আদালতের বিবেচনায় ‘ইসলামের অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ’ বা ধর্ম বিশ্বাসের অংশ না হলে রামচন্দ্রের জন্মস্থানের মতো শত ভাগ অপ্রমাণিত ধারণা রায়ের উৎস হতে পারে কেমন করে? ওদিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দাবি শ্রী রামচন্দ্র অযোধ্যায় নয়, নেপালেই জন্মগ্রহণ করেছেন। বাল্মীকি, তুলসীদাস, কৃত্তিবাস, কার রচিত রামায়ন সঠিক? রামায়ন লিখতে গিয়ে বাল্মীকি নারকের কাছে পরামর্শ চাইলে জবাবে নারদ যা বলেছিলেন, প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য বিবেচনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তা তুলে ধরছি। ‘নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ প্রকৃত অর্থে এটাই কি আদি সত্য নয়?
বিজ্ঞ আদালত হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের দোহাইতে বিচারিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যে নতুন সংযোজন ঘটালেন এরই ধারাবাহিকতায় গো-মূত্রে করোনা-ক্যান্সার নিরাময়ের প্রচলিত গণবিশ্বাসের যদি কেউ আইনগত স্বীকৃতি দাবি করেন, বা শ্রী হনুমানের কোনো ভক্ত লোক সভায় হনুমানের জন্য আসন সংরক্ষণের দাবিতে আদালতের শরণাপন্ন হোন, অথবা ইতর প্রাণী বা পশু মৈথুনের বৈধতা দাবি করেন (অবশ্য সমকামিতা আর পশু মৈথুন চেতনার দিকে অনেকটাই কাছাকাছিই বটে) তখন সমাধান কী হবে? স্মরণ রাখা দরকার, গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে রোমের আদালতের রায়ে যুক্তি বা বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসেরই জয় হয়েছিল, অবশ্য ঘটনাটি ৪০০ বছর আগের, একবিংশ শতাব্দীর নয়।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। পর্দা বা হিজাবের বিধান কেবল ইসলামে নয় অন্য সব প্রধান প্রধান ধর্মগুলোতেও বিদ্যমান। তবে ইসলামে বিধি-নিষেধগুলো কেবল নারী নয়, স্থান-কাল অনুযায়ী পুরুষের ওপর বর্তায় যা একান্তই ব্যতিক্রম। নারীদের প্রতি ঋগ্বেদের অধ্যায় ৮, অনুচ্ছেদ ৩৩ পরিচ্ছদ ১৯ এ নির্দেশনা ‘যেহেতু ব্রহ্মা তোমাদের নারী করেছেন তাই দৃষ্টিকে অবনত রাখবে, উপরে নয়। নিজেদের পা সামলে রাখো। এমন পোশাক পরো যাতে তোমাকে কেউ দেখতে না পায়।’ অতঃপর আরো বলা হয়েছে, ‘হে নারী! তুমি নিচে দৃষ্টি রাখো, ঊর্ধ্বে দৃষ্টি করো না। আপন পদযুগল একত্রে মিলিয়ে রাখো, তোমার নাক যেন কেউ দেখতে না পায়।’ ভাবটা কুরআন পাকের খুব কাছাকাছি নয় কি? তবে দৃষ্টি নিচু করার নির্দেশ কুরআন কেবল নারীদেরই দেয়নি একই নির্দেশ দিয়েছে পুরুষদেরও। হিন্দু নারী বিশেষত বিধবা ও বিবাহিতাদের ক্ষেত্রে মাথা ঢাকা বা ঘোমটা (লক্ষণীয়, ঘোমটা বা অবগুণ্ঠন হিজাবের প্রতিশব্দ হলেও কিন্তু আরবি শব্দ নয়) এক সময় একটি অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে শত ভাগ মেনে চলা হতো। এখনো পূজা অর্চনাও গুরুজনদের ভক্তি জানাতে ঘোমটা বা অবগুণ্ঠন শালীনতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়।
ধর্ম বিশ্বাস ও অনুশাসন; নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিষয়টি মূল্যায়ন করা যাক। ভারতের রাজধানী দিল্লি দূষণ আর ধর্ষণের দিক থেকে ইতোমধ্যে প্রথম স্থানে পৌঁছে গেছে বলে বলা হয়। প্রায় একই কথা বলা যায় আমাদের ঢাকার ক্ষেত্রেও। ২০১২ সালে জ্যোতি সিংহ পান্ডে নামের এক তরুণী দিল্লিতে স্ত্রীলোকবাহী বাসে গণ-ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় প্রশাসনের টনক নড়তে দেখা গেল। দারুণ একটা ঝাঁকুনি অনুভূত হলো ভারতীয় সমাজে। অপরাধ দমনে তৎপরতার পাশাপাশি কোনো কোনো রাজ্যে মেয়েদের জিন্সের প্যান্ট ও সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হতেও দেখা গেল। এই তৎপরতা হাতেগোনা কয়েক দিন। একসময় সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে ধর্ষণও তার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল ‘স্বমহিমা’য়।
বছরখানেক আগে এনডিটিভি’র এক অনলাইন প্রতিবেদনে চেন্নাই এর আর এক মর্মান্তিক ঘটনা বিশ্ববাসীর নজরে এলো। যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নিতান্ত গরিব পরিবারের এক মেয়ে। যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার সব দেশে সাধারণত দুর্বল-অসহায়রাই হয়ে থাকে। যৌন হয়রানি ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তির উপায় হিসেবে সে আত্মহত্যার পথটিই বেছে নিল। একাদশ শ্রেণীর ঐ ছাত্রী সুইসাইডের কারণ একটি চিরকুটে লিখে গেছে যা যেকোনো কঠিন হৃদয়কেও আহত ও বিচলিত করার মতো। ‘মেয়েরা শুধু মাতৃগর্ভে ও গোরেই নিরাপদ’ শিরোনামে শুরু করা সেই সুইসাইড নোটটি ‘আমার জন্য ন্যায়বিচার’ উপসংহার টেনে শেষ করেছে সে। চিরকুটে সে লিখেছে, তার বিদ্যালয়ও তার জন্য নিরাপদ নয়। শিক্ষকদের বিশ্বাস করা যায় না। (মানে, বাংলাদেশী ‘জলধর’দের মতো ওৎ পেতে থাকা শিকারী ওখানেও কম নয়।) এমনকি স্বপ্নেও সে নির্যাতনের দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়। এ জন্য সে লেখাপড়ায় মন দিতে এমনকি ঘুমোতেও পারে না। চিরকুটে সে বাবা-মায়েদের উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও রেখেছে। তা হলো, মেয়েদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করার বিষয়টি প্রত্যেক মা-বাবা তাদের ছেলে সন্তানদের শেখানো উচিত।’ তার কষ্টদায়ক উপলব্ধি, ‘আত্মীয়, শিক্ষক, প্রতিবেশী সবাই মেয়েদের হয়রানি করে, বিশেষ করে যৌন হয়রানি। এটা বন্ধ করুন।’ একই খবরে প্রকাশ, একই সময় তামিলনাড়–তে চারটি মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে অভিযোগ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
উপর্যুক্ত সুইসাইড নোটটিতে যে ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে তা কেবল ভারতের নয়, বাংলাদেশেরও। তবে বোধ করি একটি ক্ষেত্রে তার মূল্যায়ন সঠিক নয়। সে লিখেছে, ‘মেয়েরা কেবল মাতৃগর্ভে আর গোরেই নিরাপদ।’ কিশোরী মেয়ে, জীবন অভিজ্ঞতা কম বলে সে মাতৃগর্ভকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছে। কারণ সে জানেই না যে তার জন্মভূমি ভারতে প্রতিদিন হাজার হাজার কন্যা শিশু মাতৃগর্ভেই হত্যার শিকার হয় শুধু লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে। ভারতে গর্ভপাত ‘আইনসম্মত খুন’ হওয়ার সুবাদে এই নির্মমতাটা বলতে গেলে কেবল কন্যা শিশুর বেলায় ঘটে। দুনিয়াতে মেয়ে জন্মের হার ভারতে সবচেয়ে কম হওয়ার কারণ এখানেই। আর এভাবে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই লক্ষ লক্ষ কন্যা শিশু খুনের শিকার হলেও বিচার নেই, বলা যায়, সেই সুযোগও নেই। ইসলামের আগে জাহেলি যুগে আরবের অবস্থাটাও কম-বেশি ভারতের মতোই ছিল। জন্মের আগে লিঙ্গ পরিচয় জানার উপায় তখন ছিল না বলে জন্মের পরই কন্যা শিশুদের হত্যাযজ্ঞ হতো আরবে। হৃদয় কম্পন সৃষ্টি করার মতো কুরআন পাকের একটি মাত্র ঘোষণা ‘আর যখন জীবন্ত পুঁতে ফেলা কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল’ (সূরা তাকভীর ৮-৯) নাযিল হওয়ার সাথে এই নির্মমতা চিরতরে আরব ভূখণ্ড থেকে দূরীভূত হয়ে সে বিষয় আর কোনোদিন ভাবতে হয়নি মুসলিম বিশ্বকেও। কুরআনের ভাষাশৈলী ও আঘাতের তীব্রতা এখানে লক্ষণীয়। কুরআনের ঘোষণা, অভিযুক্ত খুনীকে নয়, শেষ বিচারের দিন আল্লাহ বরং খুনের শিকার নিষ্পাপ কন্যা শিশুটির কাছেই কৈফিয়ৎ তলব করবেন, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? আল্লাহর ক্রোধের এহেন বহিঃপ্রকাশ হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত একটি নিষ্ঠুরতাকে কোনো প্রকার দণ্ডবিধি কার্যকর করা ছাড়াই এমনভাবে নির্মূল করেছিল যার নজির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।
Leave a Reply