অতিমারী আবহে টানা দুই বছর নাজেহাল অবস্থা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর। বিশ্বের সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনারও আজ এ-কি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশের কথা বলা নিতান্তই কালক্ষেপণ। বিশ্বের সমাজ ও পরিবেশবিজ্ঞানীদের গভীর বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট হয় যে, বিশ্বের এযাবৎ ঘটে যাওয়া মহামারী ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অধিকাংশেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ পরিবেশের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ অর্থাৎ বহুলাংশেই দায়ী পরিবেশের ওপর মানুষের নির্মম অত্যাচার তথা দূষণ।
ভোগবিলাসিতার স্বপ্নবিভোর দুর্নিবার আগ্রাসী আক্রোশে প্রকৃতির ওপর যতই আক্রমণ হেনেছে মানুষ; প্রকৃতিও সময়ে সময়ে তার প্রতিশোধ নিয়েছে নিঃশব্দে নীরবে! মানুষের নীরব শিক্ষক হলো, প্রকৃতি। মানুষের বাঁচামরা সম্পূর্ণই যে প্রকৃতিনির্ভর, তা মানুষ কখনো মানতে না চেয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছে।
আজকাল দেখা যায় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে জলাশয় ভরাট করে, ডেভেলপার কোম্পানি খুলে ক্ষমতার অপব্যবহার আর জবরদখল করে জমি ও নদী দখল করে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। অজস্র এ ধরনের কর্মকাণ্ড কর্তৃপক্ষের সুপারিশেই হয়ে থাকে। প্রকৃতির ওপর আক্রমণে যাওয়ার আগে বিষয়টি ভাবা দরকার। সভ্যতার চাহিদা পূরণ ও বিপুল জনগোষ্ঠীর অন্ন বস্ত্র বাসস্থানে প্রকৃতির ওপর আক্রমণ নেমে আসছেই। কিন্তু যতটা কম ক্ষতি হয় সেটি কি দেখতে হবে না?
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদাসীনতা আরেকটি আক্রমণ। প্লাস্টিক থেকে শিল্প, কৃষি কলকারখানা নগর শহরের বিষাক্ত বর্জ্যও নির্দ্বিধায় ফেলা হচ্ছে নদী কিংবা সাগরে। প্রায় সব বর্জ্যরেই তো শেষ ঠিকানা সাগর বা মহাসাগর। গ্রাম শহর নগর থেকে নিকাশি ব্যবস্থা ছাড়া নদীপথে বর্জ্যরে শেষ আশ্রয় পানি। বিষিয়ে যাচ্ছে জীবকুলের পরশমণি পানি। পৃথিবীর মোট আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশ পানি হয়েও আজ পানির জন্য মহা হাহাকার। আবার মোট পানির মাত্র শতকরা আড়াই ভাগই ব্যবহারযোগ্য ও পানযোগ্য। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশও বিষাক্ত হচ্ছে মানুষের যথেচ্ছ অত্যাচারে। উন্নয়নের আলিঙ্গনে অতিষ্ঠ ভূ-উন্নয়নের কারণে পাহাড়ে গলছে হিমবাহ। সমুদ্র ধেয়ে আসছে স্থলভাগ গ্রাস করতে। বাড়ছে বন্যা; জলোচ্ছ্বাস গিলছে সভ্যতা। ক্রমাগত গিলতে আসছে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল। অসময়ে পাহাড়েও দেখা যাচ্ছে ক্লাউড বাস্ট বা হড়কাবান, জলোচ্ছ্বাসসহ ব্যাপক ধ্বংস। পাশাপাশি সমুদ্র বিষিয়ে ব্যাপক মৃত্যু হচ্ছে জলজ জীবগোষ্ঠীর যার অন্যতম কারণ প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দ্রব্য। পরিবেশবিজ্ঞানীদের বক্তব্য- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম দায় মানুষের।
জল স্থল অন্তরীক্ষ মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্যরে ভারে বিষিয়ে উঠেছে। আগ্রাসী আক্রমণ চলছে মুনাফা গড়তে। ভোগবিলাসী মানুষ চরম আগ্রাসী হয়ে পরিবেশের ওপর নির্বিচারে আক্রমণে মেতেছে। নির্মমভাবে তার আশ্রয়দাতাকে আক্রমণ করে চলেছে।
তাই তো উদ্বিগ্ন কবি লিখেছিলেন ‘মানুষ অমিতাচারী। যতদিন সে অরণ্যচর ছিল, ততদিন অরণ্যের সাথে পরিপূর্ণ ছিল তার আদান-প্রদান। ক্রমে সে যখন নগরবাসী হলো, তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধ হারাল। সে তার প্রথম সুহৃদ, দেবতার আতিথ্য যে তাকে প্রথম বহন করে এনে দিয়েছিল, সেই তরুলতাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করল ইট-কাঠের বাসস্থান তৈরি করার জন্য। আশীর্বাদ নিয়ে এনেছিল যে শ্যামল বনলী, তাকে অবজ্ঞা করে মানুষ অভিসম্পাত বিস্তার করল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রবল চাপ বাড়ছে প্রকৃতির ওপর।’
বাসস্থান নির্মাণের জন্য প্রকৃতির ওপর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক আক্রমণের ফলে বদলে যাচ্ছে মাটির প্রকৃতি। বিশ্বব্যাপী ক্রমেই বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। উন্নত দেশগুলোতে মাথাপিছু গাড়ির সংখ্যা এ দেশের তুলনায় অনেক বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর কুড়ি শতাংশ (সেগুলো আবার ‘উন্নত’ দেশ!) বিশ্বের মোট শক্তি-সম্পদের আশি শতাংশ ব্যবহার করছে। আর গরিব ও অনুন্নত দেশগুলো যেখানে মোট বিশ্ব জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বসবাস, সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে মোট শক্তি-সম্পদের মাত্র কুড়ি শতাংশ!
উদ্বেগজনক ঘটনা হলো, ওই উন্নত দেশগুলোই বিশ্বের ৮০ শতাংশ দূষণ ছড়াবার জন্য দায়ী! তারাই ৮০ ভাগ গ্রিন হাউজ ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। আর সেসব দেশের ‘দাদাগিরি’র বিষদাঁত চেপে বসছে অনুন্নত ও গরিব দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর পিঠে। দূষণজনিত কারণে ক্রমেই ক্ষুধা ও অপুষ্টিঘটিত নানা জটিল ব্যাধিও বাড়ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। দেখা গেছে, বিশ্বের মোট শক্তির ২৯ শতাংশ খরচ হচ্ছে গৃহস্থালির কাজে, যা কোথাও মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটাচ্ছে; কোথাও বা সর্বোচ্চ বিলাসিতার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ২৯ শতাংশ শক্তি-সম্পদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশে কার্বনডাই-অক্সাইড যুক্ত হচ্ছে ২১ শতাংশ (মোট কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণের)। একটি হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্বের মোট যানবাহনের ৭৫ শতাংশই ব্যক্তিগত ব্যবহারের। এই বিপজ্জনক বিষয়ও দূষণের সমস্যাটিকে জটিল করে তুলেছে। আজ বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ ভিন্ন দেশের জন্য। সীমিত জমিতে অধিক ফসল লাভের আশায় চলছে বেপরোয়া জৈবসার ও কীটনাশক প্রয়োগ। পাশাপাশি চলছে নিষিদ্ধ কীটনাশকের প্রয়োগ। কৃষি ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন জৈব প্রযুক্তি চাই, কমে যাক অজৈব সারের প্রয়োগ। সেখানে চলছে ঠিক তার বিপরীত কর্ম।
তাই বাড়ছে মৃত্তিকাদূষণ। অত্যধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগের কারণে বিরাট দূষণের শিকার শাকসবজি, ধান-গম সবই। আঁতকে উঠতে হয় যখন শোনা যায় মাতৃদুগ্ধেও মিলছে বিষের অস্তিত্ব! আজ জলাভূমির জীববৈচিত্র্যও চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। আরেকটি ঘটনা শুনেও আতঙ্কিত হতে হয় যে, প্রতি বছর নাকি বিশ্বব্যাপী ১.৩ বিলিয়ন টন (১৩০০০০ কোটি কেজি) খাদ্যশস্য সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অপচয় ও ইঁদুর ইত্যাদির কারণে নষ্ট হয়। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের সভায় পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন তারিখটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হবে।
প্রকৃতির যাবতীয় সম্পদের সুরক্ষা করতেই হবে। প্রকৃতির ওপর আক্রমণ নয়; প্রয়োজন সুরক্ষা নিশ্চিত করে প্রকৃতিকে প্রকৃতির নিজের মতো থাকতে দেয়া।
nayemulislamnayem148@gmail.com
Leave a Reply