২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের আগেই বিদ্রোহের আলামত পেয়েছিল তখনকার প্রশাসন। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক, গোয়েন্দা সংস্থাসহ প্রশাসন বিদ্রোহ ঠেকাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়। কেন তখনকার প্রশাসন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সেটি এখনও বড় প্রশ্ন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তদন্ত শুরু করেছে।
তদন্ত কমিশনের একজন সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, তখনকার সরকার ও প্রশাসন বিদ্রোহ ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তো ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হতো না। কেন বিদ্রোহী জওয়ানদের সঙ্গে ২৫ ফেব্রুয়ারির আগে তখনকার প্রশাসন আলোচনায় বসেনি, এক্ষেত্রে কাদের ব্যর্থতা ছিল- তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তদন্তে তখনকার সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পিলখানা সদর দপ্তর থেকে ৩টি অস্ত্র হারিয়ে যায়। এরপর অস্ত্রাগারে বাড়তি পাহারা বসানো হয়। ডিজিএফআই মহাপরিচালক বিডিআর ডিজিকে জওয়ানদের বিদ্রোহের বিষয়ে ব্রিফ দিয়েছিলেন বলে তদন্তকালে জানা যায়। এ ব্যাপারে জানতে তৎকালীন ডিজিএফআই মহাপরিচালক এবং ঢাকা ড্যাট প্রধানকে ডাকা হয়। কিন্তু তারা তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হয়নি। এ বিষয়টিও এখন তদন্ত হওয়া দরকার।
বিডিআর স্বজনদের দাবি, বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা দাবি আদায়ে অফিসারদের জিম্মি করতে চেয়েছিল। তারা হত্যা করতে চায়নি। কিন্তু কেন হত্যার ঘটনা ঘটল, কাদের ইন্ধনে হলো তা তদন্ত কমিশনকে বের করা উচিত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিডিআরের অপারেশন ডাল-ভাতসহ নানা কারণে বিডিআরে অসন্তোষ ছিল। এসব বিষয় নিয়ে বিডিআর সদস্যদের একটি গ্রুপ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবির বিষয়টি জানায়। আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা আবার তার সঙ্গে দফায় দফায় দেখা করেন। বিডিআর সদস্যদের একটি দল তাদের দাবি আদায়ে একাধিকবার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সরকারি বাসভবনে যায় সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু একবারও তার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। যে কারণে তারা লিখিত দাবি মন্ত্রীর এপিএসের কাছে রেখে আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়ার জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না পেয়ে সিপাহি সেলিম রেজা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে তাদের দাবির বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তা জানতে চায়। সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তারা পিলখানা ৫ নম্বর গেটে পাবলিক জাকির হোসেনের প্রিম কোচিং সেন্টারে দফায় দফায় মিটিং করে দাবি আদায়ের কর্মপরিকল্পনা করে। একপর্যায়ে ওই কোচিং সেন্টারের কম্পিউটারে একটি লিফলেট প্রস্তুত করে। সেই লিফলেট ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় বিতরণ করে। একটি কপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএসের কাছে দিয়ে আসে।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় ল্যান্স নায়েক জাকারিয়ার ভাড়া বাসায় গোপন মিটিং করেন বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানরা। সেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে তারা বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা হাতে হাত রেখে শপথ করেন অস্ত্রের মুখে সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে দাবি আদায় করবেন। সে অনুযায়ী বিডিআর জেসিওদের নির্দেশ দেওয়া হয় সাধারণ জওয়ানদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য।
ওই বৈঠকে ডিজির দরবারে আক্রমণে কার কী ভূমিকা হবে, অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিন ভেঙে কীভাবে অস্ত্র গোলাবারুদ নেওয়া হবে, তার পরিকল্পনা করা হয়। ওই দিন রাত ১০টায় সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিকের অফিসে মিটিং হয়। সেখানে উপস্থিত জওয়ানদের তিনি দিকনির্দেশনা দেন। এই বৈঠকেই বিদ্রোহের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে বিদ্রোহী জওয়ানরা দাবি আদায়ে তৎকালীন সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেন। তাদের বঞ্চনার কথা জানান। এমনকি দাবিসংবলিত একটি লিফলেটও তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা রাজধানীর ফার্মগেটে দাবিসংবলিত লিফলেট বিতরণ করেন ২৫ ফেব্রুয়ারির আগে। সেখান থেকে একটি লিফলেট উদ্ধারের পর পাল্টা একটি লিফলেট তৈরি করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন তৎকালীন বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহম্মেদ। পরে তিনি এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিদ্রোহীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএডি হাবিব ও জলিলের নেতৃত্বে একটি দল শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বনানীর বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। সাড়া না পেয়ে একই দল ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সরকারি বাসভবনে যায় সাক্ষাতের জন্য। পরে সাক্ষাৎ করতে না পেরে ফোনে কথা বলেন। পরদিন পুনরায় বিডিআর প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে যায় সাক্ষাৎ করতে। সেদিনও সাক্ষাৎ করতে না পেরে তার এপিএসের কাছে লিফলেটের একটি কপি দিয়ে আসে। পরের দিন রাতেও দলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় যায় সাক্ষাৎ করতে। সেদিনও দেখা না পেয়ে চলে আসে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সিপাহি সেলিম রেজা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানতে চান, তিনি তাদের দাবিসংক্রান্ত লিফলেট পড়েছেন কি না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, লিফলেট পড়ার সময় পাননি। তখন আবার জানতে চান বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে বিডিআরদের জন্য কী নিয়ে আসছেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সন্তোষজনক কোনো উত্তর না পেয়ে বিদ্রোহীরা ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিজির দরবারে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা করে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্রোহীদের একটি গ্রুপ ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে কেন্দ্রীয় কোতের দায়িত্বে থাকা লে. কর্নেল রিয়াজুল করিমকে হাত-পা বেঁধে তার অফিস কক্ষে আটকে রাখে। পরে বিদ্রোহীরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এক গ্রুপ কোত ভেঙে অস্ত্র লুট করে। আরেক গ্রুপ ম্যাগাজিন ভেঙে গোলাবারুদ লুট করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এ সময় অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিনের গার্ডরা বাধা দেয়নি। বরং সহযোগিতা করেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ডিজির দরবার শুরুর কিছুক্ষণ পর দরবার হলে আড়াই হাজার জওয়ান ও জেসিওরা ‘জাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে যে যার মতো উঠে দরবার হলের দরজা ও জানালা ভেঙে বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই দরবার হলে ঢুকে পড়ে একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপর পিলখানার ভেতর ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলে ইতিহাসের নৃশংস ঘটনা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুল আলোচিত এই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশ হয়। হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে মোট ২২টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে বলা হয়, বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ ও প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণের বিষয়টি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্ত্বেও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ না নিয়ে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা আরএসইউ এবং বিদ্রোহের পূর্বাভাস সংগ্রহে দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা; সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে অপারেশন ডাল ভাতের মতো কোনো আর্থিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত না করা এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ উদ্ঘাটন করতে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবিসহ অধীনস্থ সব বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আন্তরিকভাবে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির আগেই কর্তৃপক্ষকে আইনসম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করতে বলা হয় রায়ে। এ ছাড়া নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরে অসম প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। তাই আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নীতিশাস্ত্রের অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়।
Leave a Reply