ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হওয়ায় রাশিয়ার উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কি এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘দুমা’ ও দলীয় কার্যালয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই উদযাপন করেছিলেন।
কারণ ঝিরিনোভস্কি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় রুশ-মার্কিন সম্পর্কে (ইতিবাচক) পরিবর্তন ঘটবে।
তবে ঝিরিনোভস্কিই রাশিয়ার একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি সেসময় ট্রাম্পের বিজয় উদযাপন করেছিলেন।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার পরের দিন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আরটি’র প্রধান সম্পাদক মার্গারিটা সিমোনিয়ান এক এক্স (সাবেক টুইটার) বার্তায় এমন অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছিলেন যে মার্কিন পতাকা উড়িয়ে তিনি মস্কোর রাস্তায় গাড়ি চালাতে চান।
মস্কো আশা করেছিল যে রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর রাশিয়ার ওপর থেকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন।
এমনকি, তিনি ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসাবে স্বীকৃতিও দিয়ে দিতে পারেন বলে আশা করছিলেন অনেকে।
যদিও বাস্তবে সেসবের কিছুই ঘটতে দেখা যায়নি।
‘এত আশা-প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তি এতটুকুই ছিল যে ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রাম্প রাশিয়ায় মানবাধিকারের বিষয়ে কখনোই প্রচারণা চালাননি,’ বলছিলেন রাশিয়ার নেজাভিসিমায়া গেজেটা পত্রিকার সত্ত্বাধিকারী ও প্রধান সম্পাদক কনস্ট্যান্টিন রেমচুকভ।
ফলে তখন রুশ নাগরিকদের মধ্যে যারা একটু বেশিই আশা করে ফেলেছিলেন, তাদের সেই মোহ কাটতেও খুব বেশি সময় লাগেনি।
অনেকেই ভেবেছিলেন যে ক্ষমতায় গেলে ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন।
‘অথচ ট্রাম্পের শাসনামলেই রাশিয়ার ওপর সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞাটি দেয়া হয়েছিল,’ বলেন রেমচুকভ।
তিনি আরো বলেন, ‘বিশেষ করে গত মেয়াদের শেষদিকে তার কার্যক্রম নিয়ে অনেক মানুষ হতাশ হয়েছিল।’
আর হয়তো সেকারণেই আট বছর পর এবারের মার্কিন নির্বাচনের আগে কোনো রুশ রাজনীতিবিদ বা কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি।
এতে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে যে ট্রাম্প প্রশ্নে তারা এখন ঠিক আগের অবস্থানে নেই।
বরং এবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা গেছে ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী কমালা হ্যারিসের প্রশংসা ও সমর্থন করতে।
যদিও পুতিনের ওই প্রশংসা ও সমর্থনকে ‘ক্রেমলিন ট্রোলিং’ বা ক্রেমলিনের রসিকতা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন অনেকে।
সম্প্রতি নিজের এক বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের হাসির প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু পুতিনের মুখে যে হাসি এখনো টিকে আছে, সেটির কৃতিত্ব যে কমলার না বরং ট্রাম্পের, সেটি বুঝতে রাজনীতির বিষয়ে মহাজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বাইডেন প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করছেন।
অথচ ইউক্রেনের ওপর পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়ার ব্যাপারে তার ভেতরে যে অনিচ্ছা কাজ করছে, সেটা বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিতর্কের সময়েও তিনি ইউক্রেনকে যুদ্ধে জেতানোর বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেননি।
প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে ট্রাম্প উল্টো দাবি করেছেন যে তিনি ক্ষমতায় থাকলে এই যুদ্ধ শুরুই হতো না।
কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালা হ্যারিসকে এর ঠিক বিপরীত অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। তিনি সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে কথা বলছেন।
নানা যুক্তি তুলে ধরে কমলা বলছেন যে ‘কৌশলগত স্বার্থেই’ ইউক্রেনকে সমর্থন করা প্রয়োজন।
এসব বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি রুশ প্রেসিডেন্টকে ‘খুনি স্বৈরশাসক’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
অবশ্য রাশিয়ার টিভি চ্যানেলে যে কমলার খুব প্রশংসা করা হচ্ছে, তেমনটাও নয়।
কয়েক সপ্তাহ আগে রাশিয়ার একজন প্রথম সারির সংবাদ উপস্থাপককে কমলার রাজনৈতিক জ্ঞান ও সক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন পর্যন্ত তুলতে দেখা গেছে।
মার্কিন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে তিনি রাজনীতির মাঠ ছেড়ে টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে এসব আলাপ-আলোচনার বাইরে মার্কিন নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে, সেটি রাশিয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা নির্বাচন যদি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় এবং ট্রাম্প ও হ্যারিসের মধ্যে একজন যদি সামান্য ব্যবধানে হেরে যান, সেক্ষেত্রে দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও রেষারেষি-বিতর্ক বেড়ে যাবে।
এতে সারাদেশে নির্বাচন পরবর্তী বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি এবং সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়বে। ফলে সেগুলো ঠেকাতেই মার্কিন সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
এতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈদেশিক নীতির বিষয়ে তাদের মনোযোগ কম থাকবে বলে মনে করেন অনেকে।
সাবেক প্রসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতা নেয়ার পর রুশ-মার্কিন দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেটির আরো অবনতি হয়।
জো বাইডেনের সময়েও অবস্থার উন্নতি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সদ্য সাবেক রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনোভের ভাষায়, বাইডের প্রশাসনের অধিনে রুশ-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কার্যত ‘ভেঙে পড়েছে’।
ওয়াশিংটন অবশ্য এ ঘটনার জন্য অবশ্য পুরোপুরিভাবে মস্কোকেই দায়ী করছেন।
জেনেভায় বাইডেনের সাথে বৈঠকের মাত্র আট মাসের মাথায় ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
এরপর রাশিয়ার ওপর রীতিমত নিষেধাজ্ঞার সুনামি বইয়েছে বাইডেন প্রশাসন। সেইসাথে, গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধে টিকে থাকতে কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটি ইউক্রেনকে ট্যাঙ্ক, হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে, যা রুশ-মার্কিন সম্পর্ককে তলানিতে নামানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এসব দেখে এখন বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যে একটা সময় ছিল যখন বৈশ্বিক নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশীদার হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সেটি খুব বেশিদিন আগে ঘটনাও নয়।
১৯৮৭ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক মিখাইল গর্বাচফ দু’দেশের পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত করার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
এরপর ১৯৯১ সালে মার্কিন ফার্স্ট লেডি বারবারা বুশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাইসা গর্বাচফ মস্কোতে যৌথভাবে একটি অসাধারণ ভাস্কর্য উন্মোচন করেছিলেন।
সেটি ছিল আটটি বাচ্চাসহ একটি মা হাঁসের ভাস্কর্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন পাবলিক গার্ডেনের একটি ভাস্কর্য অনুকরণে স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছিল, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকান শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে মস্কোতে স্থাপন করা হয়েছিল।
ভাস্কর্যটি এখনো মস্কোবাসীর কাছে বেশ প্রিয়। ফলে রুশ নাগরিকদের অনেকেই ব্রোঞ্জের তৈরি হাঁস ও তার বাচ্চাদের সাথে ছবি তুলতে নোভোদেভিচ পার্কে ছুটে আসেন। তবে তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এই ‘হাঁস কূটনীতি’র পেছনের গল্প জানেন।
রুশ-মার্কিন সম্পর্কের মতো ব্রোঞ্জের হাঁসগুলোর ওপর দিয়েও নানান ঝক্কি গেছে। কয়েকটি বাচ্চা তো রীতিমত চুরিরও শিকার হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তীতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির নির্বাচন নিয়ে রুশ নাগরিকরা কী ভাবছে, সেটি খুঁজতে গিয়ে ওই হাঁস ও তার বাচ্চাদের ভাস্কর্যের কাছে গিয়েছিলাম।
‘আমি চাই আমেরিকা অদৃশ্য হয়ে যাক,’ রাগান্বিত কণ্ঠে বলছিলেন অ্যাংলার ইগর। তিনি ভাস্কর্যটির পাশেই একটি পুকুরে মাছ ধরছিলেন।
‘দেশটি বিশ্বে অনেকগুলো যুদ্ধ শুরু করেছে। সোভিয়েত আমলেও আমেরিকা আমাদের শত্রু ছিল এবং এখনো তা-ই আছে। এক্ষেত্রে কে প্রেসিডেন্ট হলো তা বিবেচ্য বিষয় নয়,’ বলেন ইগর।
এখানে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার চিরশত্রু হিসাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। সেসব খবর দেখেই কি ইগর এত রাগান্বিত হয়েছেন?
না কি মাছ ধরতে এসে আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় তার মেজাজ খারাপ? সেটাও অবশ্য হওয়া অসম্ভব কিছু না।
কারণ এখানকার যত রুশ নাগরিকের সাথে আমার কথা হয়েছে, তাদের বেশিভাগই আমেরিকাকে শত্রু বিবেচনা করেন না বলে জানিয়েছেন।
‘আমি শান্তি এবং বন্ধুত্বের পক্ষে,’ বলছিলেন স্বেতলানা নামের একজন রুশ নাগরিক।
কিন্তু আমার যে বন্ধু আমেরিকায় থাকে, সে এখন আমাকে ফোন করতে ভয় পায়। সেখানে হয়তো বাক স্বাধীনতা নেই। অথবা সম্ভবত: এখানে রাশিয়ায় বাক স্বাধীনতা নেই। আমি ঠিক জানি না,’ বলেন তিনি।
‘আমাদের দুই দেশ এবং সেখানকার জনগণের মধ্যে সম্পর্ক হওয়া উচিত বন্ধুত্বপূর্ণ,’ বলেন নিকিতা নামের আরেক রুশ নাগরিক।
তিনি আরো বলেন, ‘এক্ষেত্রে যুদ্ধ কিংবা কার কাছে বেশি ক্ষেপণাস্ত্র আছে, সেটা দেখানোর মতো প্রতিযোগিতা ছাড়াই সম্পর্ক হোক। আমি ট্রাম্পকে পছন্দ করি। তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন বড় কোনো যুদ্ধ বাঁধেনি।’
রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে নানান পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দেশ দু’টি মধ্যে একটি বিষয়ে বেশ মিল রয়েছে। সেটি হলো, দু’দেশেই কখনো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হতে দেখা যায়নি, সব সময় পুরুষরাই হয়েছে।
রুশ নাগরিকরা কি কখনো এই অবস্থার পরিবর্তন দেখতে চায়?
‘আমি মনে করি যে, একজন নারী দেশের প্রেসিডেন্ট হলে ব্যাপারটা দারুণ হবে,’ বলেন মেরিনা।
‘এখানে (রাশিয়ায়) একজন নারী প্রেসিডেন্টকে ভোট দিতে পারলে আমি খুশি হবো। আমি বলছি না যে, সেটি ভালো বা খারাপ হবে। তবে বেশ ভিন্ন একটা ব্যাপার হবে,’ বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply