পাঠ্যপুস্তকে বিতর্কিত কারিকুলামের বেশ কিছু বিষয় সংশোধন হচ্ছে। প্রথম সংশোধনীতে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন অনেক ছবি ও বিষয়ও বাদ যাবে। বিশেষ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে আগে থেকেই গ্রহণযোগ্য ছিল না; কিন্তু তারপরেও বাধ্য হয়েই তাদেরকে সেসব বিষয় পড়তে বা পড়াতে হয়েছে এখন সেই বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেয়া হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে অর্থাৎ ২০২৫ সালের শুরুতে শিক্ষার্থীরা যে পাঠ্যবই হাতে পাবে সেখানে বেশ কিছু বিষয়ে পরিমার্জিত বা সংশোধন করেই ছাপানো হবে পাঠ্যবই। আর এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময়ও লাগবে। ফলে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডার প্রক্রিয়াতে কিছুটা গতি কমেছে।
এ দিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে নতুন কারিকুলামের বেশ কিছু বিষয়ে বিতর্ক থাকায় এবং বিভিন্ন পক্ষ থেকে আপত্তি থাকায় সেসব বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, শিক্ষা মন্ত্রণায়য় বা শিক্ষা উপদেষ্টার দফতর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। তারা এনসিটিবিতে সশরীরে এসে বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া কিভাবে হবে তা নির্ধারণ করতে কাজও শুরু করেছেন।
অন্য দিকে গত কয়েক বছরে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে- এমন অভিযোগ করে আসছেন দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা। তারা বলছেন, শিক্ষকরা হলেন শিক্ষাব্যবস্থার বড় অংশীজন। অথচ শিক্ষকদের সাথে না নিয়েই বা তাদের সাথে আলোচনা না করেই তৈরি করা হয়েছে নতুন কারিকুলাম। এসব পড়াতে গিয়ে বিব্রতও হতে হচ্ছে তাদের। সব মিলিয়ে নতুন কারিকুলাম শুধু শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের জন্যই নয়; বরং শিক্ষকদের জন্যও বিব্রতকর এবং উদ্বেগের।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করতে সুপরিকল্পিতভাবেই শিক্ষার নানা বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের নামে পাঠ্যবইয়ে এমন সব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যা আমাদের শিক্ষার্থীদের সাথে কোনোক্রমেই মানানসই নয়। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা হয়েছে বিতর্কিত নানা বিষয়। নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ শ্রেণীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে (পৃষ্ঠা নং ৪৭, ৪৮, ৪৯) এমন সব বিষয় পাঠ্যসূচিতে ঢোকানো হয়েছে যাতে আমাদের কোমলমতি শিশুদের লজ্জাহীন বানানোর পাঁয়তারা করা হয়েছে। একই সাথে ‘চলো বন্ধু হই’ শিরোনামের গল্পে (পৃষ্ঠা নং ৮৯) কিশোর-কিশোরীদের মনে বন্ধুত্বের আড়ালে তাদেরকে প্রেম ভালোবাসায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক অভিভাবকের অভিযোগ- নতুন কারিকুলামের শিক্ষায় চিরাচরিত আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ধারায় পারিবারিক শাসনকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে আদরের সন্তানদের মাথা বিগড়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে (৭৭ থেকে ৮০ নং পৃষ্ঠায়) এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিশোর-কিশোরীদের মনে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চিরন্তন যে আবেগ আকর্ষণ সে বিষয়গুলোও পাঠ্যবইয়ে স্থান দেয়া হয়েছে। আবার আমাদের মূল ইসলামী সংস্কৃতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে হিন্দু সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের অতীত ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়ে মুসলিম বীরদের দখলদার হিসেবে চিত্রায়িত করে মুসলমানদের অবদানকে খাটো করার পাশাপাশি বাংলা ভূখণ্ডের স্থপতি হিসেবে মুসলমানদের অবদানকেও অস্বীকার করে সঠিক ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব যাদের ওপরে ন্যস্ত খোদ সেই শিক্ষকরাও এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি আয়োজিত কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন সংক্রান্ত সভায় আগত শিক্ষকদের সবাই নতুন কারিকুলাম নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির (বাসমাশিস) সাবেক মহাসচিব এমারত হোসেন মিয়া বলেন, ছাত্রদের রক্তের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে এতে শিক্ষকরাও তাদের সম্মান ফিরে পাবেন। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র। এটি মোকাবেলায় মাধ্যমিক শিক্ষকরা সবসময় সচেষ্ট ছিলেন, এখনো আছেন। এটি পরিবর্তিত না হলে এ জাতি পঙ্গু জাতিতে রূপান্তরিত হবে। শিক্ষকদের আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ রুহুল্লাহ বলেছেন, নতুন কারিকুলাম নিয়ে সবার মধ্যেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষকরা বড় অংশীজন হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাদ দিয়ে এ কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। নতুন কারিকুলাম পড়াতে গিয়ে আমাদের বিব্রতও হতে হচ্ছে। কারিকুলামে এমন কিছু বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে যার ফলে জাতি হতাশ হয়েছে।
আজিমপুর গার্লস স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক আজাদ রহমান জানিয়েছেন, যখন এ কারিকুলাম এলো, বড় অভিযোগ এলো শিক্ষকরা কিছু জানেন না। অথচ কারিকুলাম তৈরির সময় শিক্ষকদেরই ডাকা হয়নি। আমরা এ কারিকুলাম পড়াতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছি। এ কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতিও ত্রুটিপূর্ণ। আমরা আশা করছি, কারিকুলামের পরবর্তী পর্বে অংশীজন হিসেবে আমাদেরও অংশগ্রহণ সেখানে থাকবে। এতদিন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে আমাদের রাখা হয়নি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি’র সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো: মোখলেছুর রহমান গতকাল রোববার বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, পাঠ্যক্রমে কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জন আনতে হলে এটা একটি কমিটির মাধ্যমে করতে হয়। ইতোমধ্যে নতুন কারিকুলামের পাঠ্যসূচিতে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা নিয়মিতই এনসিটিবিতে আসছেন এবং কী কী বিষয়ে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা যেতে পারে তা নিরূপণ করছেন।
অন্য দিকে এনসিটিবির উৎপাদন শাখা থেকে জানা গেছে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নতুন বই মুদ্রণের টেন্ডার এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে টেন্ডার হওয়ার পরেও পাঠ্যবইয়ে যদি কোনো পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রয়োজন হয় তবে সেটিও করা যায়। কেননা পাঠ্যবইয়ের কোনো অংশের পরিবর্তন করতে হলে শুধু বাঁধাইয়ের আগে ওই অংশটুকু বা ওই ফর্মা যোগ করে দিয়েই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
Leave a Reply