মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলে হামলায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার এক ব্যক্তি জানিয়েছেন যে, হামলা চালানোর জন্য তাকে পাঁচ লাখ রুবল বা পাঁচ হাজার ৪০০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো।
রুশ সংবাদ মাধ্যম আরটি’র এডিটর-ইন-চিফ মার্গারিটা সিমোনিয়ানের একটি টেলিগ্রাম পোস্টের বরাত দিয়ে রোববার এই তথ্য জানিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস।
‘টাকার জন্য আমি ক্রোকাসে মানুষের ওপর গুলি ছুঁড়েছি। আমাকে প্রায় ৫,০০,০০০ রুবল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো,’ বলেছেন সন্দোহভাজন ওই ব্যক্তি।
তাসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য হামলায় আগেই ওই ব্যক্তিকে কার্ডে প্রতিশ্রুত অর্থের অর্ধেক অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছিল।
এছাড়া কাজ শেষ হওয়ার পর বাকি টাকা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছিলো।
যদিও গ্রেফতারের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে ওই ব্যক্তি কার্ডটি হারিয়ে ফেলেছেন বলে জানানো হয়েছে তাসের প্রতিবেদনে।
তবে তাস বার্তা সংস্থার এই প্রতিবেদনের তথ্য অন্য কোন সূত্রে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, হামলায় নিহতদের স্মরণে রোববার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করছে রাশিয়া।
শনিবার দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিন একদিনের এই রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেন।
“২৪শে মার্চকে আমি সারা দেশের জন্য শোক দিবস ঘোষণা করছি,”এক টেলিভিশন ভাষণে বলেন মি. পুতিন।
ঘোষণা অনুযায়ী, রোববার দেশটিতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
টেলিভিশনের ওই ভাষণে পুতিন এটাও বলেছিলেন যে, হামলার ঘটনার সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদেরকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
গত শুক্রবার মস্কোর ক্রোকাস সিটিতে একটি কনসার্ট চলাকালে হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। ওই হামলায় ১৩৩ জন নিহত হয়।
জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করলেও রাশিয়া দাবি করেছে যে, হামলার সঙ্গে ইউক্রেন জড়িত রয়েছে।
যদিও রাশিয়ার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে কিয়েভ।
উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি
বন্দুকধারীদের হামলার পর ঘটনাস্থল মস্কোর ক্রোকাস সিটিতে শুরু হওয়া উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি টানা হয়েছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘তাস’।
ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সর্বমোট ১৩৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মস্কো অঞ্চলের গভর্নর আন্দ্রে ভোরোবিভ। তবে ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান শেষ হলেও আশপাশের এলাকায় অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত এক বার্তায় গভর্নর বলেন, ‘দুর্ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে, তবে বাইরের এলাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনও চলছে।’
এছাড়া হামলায় নিহত ১৩৩ ব্যক্তির মধ্যে ৫০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বাকিদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয়েছে।
পাশাপাশি আহত ১০৭ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনভ বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী হামলা’ এবং ‘পশ্চিমাদের হাইব্রিড যুদ্ধ’ রাশিয়ার চলার পথ ও বৈদেশিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না।
আন্তোনভ বলেন, ‘তারা (কিয়েভে) যা কিছু সরবরাহ করছে, সবই ধ্বংস করে দেওয়া হবে।’
কিয়েভে আক্রমণ জোরদার
মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্টে বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনার একদিন পর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলা শুরু করেছে রাশিয়া।
রোববার স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটার দিকে এই হামলা শুরু হয়। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা কিয়েভ শহর।
কিয়েভের বাসিন্দা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নেওয়ার ছবি প্রকাশ করছেন।
তবে হামলায় হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি।
তাছাড়া রোববারের এই হামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত মস্কোও কোনো মন্তব্য করেনি।
নতুন করে রাশিয়া বিমান হামলা শুরু করায় পুরো ইউক্রেনে সতর্কতা জারি করা হয়েছে যেন নাগরিকরা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে যে, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে তারা রাশিয়ার বিমান হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।
কিয়েভের সামরিক প্রশাসনের প্রধান সের্হি পপকো জানিয়েছেন, রাজধানী শহর কিয়েভ এবং এর আশেপাশের এলাকায় তাদের সৈন্যরা রাশিয়ার প্রায় এক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছেন।
এর আগে মস্কোয় কনসার্ট হলে হামলাকারীদের সাথে সাথে ইউক্রেনের যোগাযোগ ছিলো বলে দাবি করেছে রাশিয়ার সিকিউরিটি সার্ভিস।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা রিয়া নোভোস্টি বলছে, রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা তাদেরকে জানিয়েছে যে ‘শনিবার সকালে হামলাকারীদের ব্রায়ানস্ক অঞ্চলে আটক করা হয়েছিল। ঐ সময় তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউক্রেন পার হতে চেয়েছিল এবং ইউক্রেনের পক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছিল’।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তার ভাষণে অভিযোগ করেছিলেন, ‘প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সীমান্তে তাদের জন্য ইউক্রেনিয়ানরা একটি জায়গা তৈরি করছিলো’।
তবেইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলনোস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক স্পষ্টভাবে ইউক্রেনের জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন।
তিনি তখন বলেছিলেন যে ‘তার দেশের এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কোন সুযোগ নেই’।
এর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত চলছে এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ।
আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ
অন্যদিকে, পোল্যান্ড জানিয়েছে যে, রাশিয়ার একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
দেশটির সীমান্ত ঘেঁষা ইউক্রেনের শহর লুভিউয়ে হামলা চালানোর সময় রাশিয়ার ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি পোল্যান্ডের আকাশসীমায় সামান্য ঢুকে পড়ে বলে জানানো হয়েছে।
এ ঘটনার পর নিজেদের আকাশসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পোলিশ বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
পোলিশ সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশনাল কমান্ড (আরএসজেড) বলেছেন, ‘পোল্যান্ড ও তার সহযোগীদের যুদ্ধবিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘পোল্যান্ড তার আকাশসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং আরএসজেড পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।’
মস্কোয় হামলাকারীরা কারা?
মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলে শুক্রবারের হামলা ছিলো বহু বছরের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরুর পর কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে বন্দুকধারীদের হামলা চালানোর এই ঘটনায় ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ইসলামিক স্টেট গ্রুপ (আইসিস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
শুক্রবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আইএস বলেছে তারাই এ হামলা চালিয়েছে। শনিবার মুখে মাস্ক পরিহিত চার হামলাকারীর ছবি তারা প্রকাশ করা করে।
রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ এ দাবির বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি। তবে মস্কোর বড় কোন সমাবেশে হামলা হতে পারে- যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সতর্কতা দেয়ার দু সপ্তাহ পর এ দাবিটি এলো।
রাশিয়ান কর্মকর্তারা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বিস্তারিত কোন তথ্য দেয়নি।
গত সপ্তাহে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন: ‘রাশিয়ায় সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে কয়েকজন পশ্চিমা কর্মকর্তার উস্কানিমূলক বিবৃতি হলো ব্লাকমেইলিংয়ের মতো এবং ভয় দেখানো ও সমাজকে অস্থিতিশীল করার জন্য’।
হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
যুক্তরাষ্ট্র যাদের চিহ্নিত করেছে তারা হলো আইসিস-খোরসান বা আইসিস-কে।
সংগঠনটির উদ্দেশ্য হলো আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও ইরান জুড়ে মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা।
‘আইসিস-কে রাশিয়ার ওপর দৃষ্টি দিচ্ছে গত দু বছর ধরে,’ নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ককে উদ্ধৃত করে বলেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
‘আফগানিস্তান, চেচনিয়া ও সিরিয়ায় মস্কোর হস্তক্ষেপের দিকে ইঙ্গিত করে আইসিস-কে’র অভিযোগ হলো ক্রেমলিনের হাতে মুসলিমদের রক্ত,’ ক্লার্ক বলছিলেন।
তবে রাশিয়া কর্তৃপক্ষ আইসিসের দাবির বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি।
পুতিন বলেছেন ইউক্রেনের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় হত্যাকারীদের আটক করা হয়েছে।
‘প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সীমান্তে তাদের জন্য ইউক্রেনিয়ানরা একটি জায়গা তৈরি করছিলো,’ বলছিলেন মি. পুতিন।
ইউক্রেন রাশিয়ার এ দাবি ‘অসম্ভব’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া
মস্কোয় হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, তুরস্ক, ইরান, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশের নেতারাও ‘সন্ত্রাসী হামলার’ নিন্দা জানিয়েছেন বলে বার্তা সংস্থা এএফপি’র খবরে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মস্কোয় ‘সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা’ মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন মুখপাত্র ফারহান হক।
একই সাথে ‘নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবার এবং রাশিয়ার জনগণ ও সরকারের প্রতিও গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন’ মি. গুতেরেস।
এদিকে, মস্কোয় ‘ভয়াবহ’ গুলিতে হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হামলার বিষয়ে তারা আরও তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করছে বলেও জানানো হয়েছে।
দেশটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভয়ানক এই গুলির ঘটনায় হতাহতদের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন যে, ‘হামলার ছবিগুলো রীতিমত ভয়ঙ্কর এবং দেখা বেশ কঠিন।’
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, মস্কোতে ‘বড় জমায়েত’ লক্ষ্য করে একটি ‘পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা’ হতে পারে বলে মার্চের শুরুতেই তারা রুশ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলো।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে যে, মস্কোর হামলার ঘটনা দেখে তারা ‘মর্মাহত’ হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘ইইউ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের হামলার নিন্দা জানায়। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত রুশ নাগরিকদের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি।’
অন্যদিকে, হামলার ঘটনায় ‘কঠোর নিন্দা’ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, মি. শি জোর দিয়ে বলেছেন যে, চীন সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।
মস্কোয় ‘সন্ত্রাসী হামলার’ তীব্র নিন্দা করে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য রুশ সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply