গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান এখন ইতিহাসের সব চেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনার অন্যতম হয়ে উঠেছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।
মাত্র দু মাসের সামান্য বেশি সময়ে এই আক্রমণ যতখানি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার আলেপ্পো, ইউক্রেনের মারিউপল কিংবা সেই অনুপাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির উপর মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণকে ছাড়িয়ে গেছে।
ইসলামিক স্টেট গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের তিন বছরব্যাপী অভিযানে যত বেসামরিক লোক প্রাণ হারিয়েছে, ইসরাইলের আক্রমণে নিহত হয়েছে তার চেয়েও বেশি বেসামরিক মানুষ।
ইসরাইলিরা গাজায় কী ধরণের বোমা এবং গোলন্দাজ ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী কিছুই জানায়নি। কিন্তু ঘটনাস্থলে বিস্ফোরকের টুকরো এবং আক্রমণের ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে ওই অবরুদ্ধ ছিটমহলে নিক্ষিপ্ত বোমার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।
তারা বলছেন, এই সব অস্ত্র-শস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৯০০ কিলোগ্রাম ওজনের ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা। আর এর ফলে বিপুল জন-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে শত শত লোক নিহত হয়েছে।
গাজায় নিহতদের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অস্ত্র বিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরাইল এই চাপ অব্যাহত রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চায়।
তারা বলছে হামাসের ৭ অক্টোবর সীমান্ত পেরিয়ে ধ্বংসয্জ্ঞ চালানোর প্রতিক্রিয়ায় তারা হামাসের সামরিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। সাত অক্টোবরের ঐ ঘটনায় যুদ্ধের সুত্রপাত, যাতে হামাস ১২০০ লোককে হত্যা করে এবং আরো ২৪০ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৭ সালে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসরাইল, মিসর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানও হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে।
বাইডেন প্রশাসন নীরবেই ইসরাইলের কাছে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে । তবে গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন যে ইসরাইল, তার কথায়, ‘নির্বিশেষে বোমা আক্রমণ’ চালিয়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বৈধতা হারাচ্ছে।
গাজায় ধ্বংসের পরিমাণ কত?
যুদ্ধের সময়ে এলাকাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহে বিশেষজ্ঞ দুটি প্রতিষ্ঠান ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যামন ভ্যান ডেন হক এবং কিউনি গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের কোরি শের-এর কপারনিকাস সেন্টিনেল–ওয়ানের স্যাটেলাইট উপাত্ত অনুযায়ী, ইসরাইলের আক্রমণে গাজার উত্তরাঞ্চলে ভবনগুলোর দুই-তুতীয়াংশেরও বেশি ধ্বংসে পরিণত হয়েছে এবং দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকায় এক-চতুর্থাংশ ভবন ধ্বসে পড়েছে।
তারা বলেন, খান ইউনিস এলাকায় বিধ্বস্ত ভবনের শতকরা হার, মাত্র প্রথম দু সপ্তাহে দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলের আক্রমণের প্রায় দ্বিগুণ।
আর এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও দোকানপাট।
জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষকরা বলছেন গাজাজুড়ে প্রায় ৭০ শতাংশ স্কুল ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ৫৬টি স্কুল বাস্তুচ্যূত লোকদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
ইসরাইলের আক্রমণে ১১০টি মসজিদ ও তিনটি গির্জা ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন।
বেসামরিক লোকজনের মৃত্যুর জন্য ইসরাইল হামাসকে দায়ী করেছে। ইসরাইল বলছে, বেসামরিক অবকাঠামোর মধ্যে হামাস সদস্যদের ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওইসব স্থানে অনেক ফিলিস্তিনিও আশ্রয় নেন, যারা নিরাপদ স্থানে সরে যাবার ইসরাইলের নির্দেশে সেদিকে পালিয়ে গেছে।
শের বলেন, ‘গাজা এখন এক ভিন্ন রূপে দেখা দিয়েছে।’ যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র তৈরিতে ভ্যান ডেন হোয়েকের সাথে কাজ করেছেন শের।
ঐতিহাসিকভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞের স্থান কোথায়?
কোনো কোনো হিসেবে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বোমা বর্ষণকেও ছাড়িয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ইতিহাসবিদ রবার্ট পেইপ বলেন, ১৯৪২-৪৫ সাল পর্যন্ত মিত্রবাহিনী ৫১টি প্রধান জার্মান শহরে আক্রমণ চালায়, যাতে তাদের শহুরে এলাকার ৪০-৫০ ভাগ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পেইপ বলেন, এই সংখ্য হচ্ছে গোটা জার্মানির ১০ ভাগ ভবন আর এর তুলনায় মাত্র ১৪০ বর্গ মাইল এলাকার বিপুল সংখ্যাধিক্যের শহর গাজায় বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৩ ভাগেরও বেশি ভবন।
পেইপ বলেন, ‘গাজা হচ্ছে ইতিহাসে বেসামরিক লোকদের সবচেয়ে মারাত্মক শাস্তির অভিযান। আর এটাই সব চেয়ে ধ্বংসাত্মক বোমা অভিযানের কোয়ারটাইলের শীর্ষে রয়েছে।’
ইরাকের শহর মসুল থেকে ২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেট গ্রুপকে বিতাড়িত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অভিযান কয়েক প্রজন্মের মধ্যে সব চেয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ বলে বিবেচনা করা হতো।
ওই সময়ে অ্যাসোসিয়েটড প্রেসের এক তদন্ত অনুযায়ী, নয় মাসের ওই লড়াইয়ে প্রায় ১০,০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়, যার এক-তৃতীয়াংশ নিহত হন জোটের বোমা বর্ষণে।
ইরাকে আইএসকে পরাস্ত করতে ২০১৪-২০১৭ সালের আক্রমণ অভিযানে জোট গোটা দেশ জুড়ে প্রায় ১৫,০০০ বার আঘাত হানে। এ কথা জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক নিরপেক্ষ গোষ্ঠী এয়ারওয়ার্স যারা সাম্প্রতিক সংঘাতের রেকর্ড রাখে।
সেই তুলনায় গত সপ্তাহে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর নিজস্ব ভাষ্যে বলা হয়েছে, গাজায় তারা ২২ হাজার বার আঘাত হেনেছে।
কী ধরণের বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে?
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী কী ধরণের বোমা ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানায়নি। তারা বলছে, এই আক্রমণগুলো যাতে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে সেজন্য প্রত্যেকবার তা আইনি উপদেষ্টাদের দ্বারা অনুমোদিত হয়।
সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ‘আমরা প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুর জন্য সঠিক অস্ত্র ব্যবহার করছি যাতে কোন রকম অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি না হয়।’
অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট স্থানে বিস্ফোরকের ভগ্নাংশ, সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত স্যাটেলাইটের ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন। তারা বলছেন, বিমান যুদ্ধের কেবল সামান্যটাই এতে দেখা যাচ্ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অস্ত্র তদন্তকারী ব্রায়ান কাস্টনারের মতে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশান (জেডিএএম) বোমা এবং ছোটমাপের কিছু বোমার ভগ্নাংশ গাজায় পাওয়া গেছে।
জেডিএএম বোমাগুলির মধ্যে রয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে সক্ষম ১,০০০ ও ২,০০০ পাউন্ডের “বাংকার বাস্টার”।
পেন্টাগনের একজন সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এবং জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক তদন্তকারী মার্ক গ্যারলাস্কো বলেন, ‘এই বোমা মাটিকে তরল পদার্থে পরিণত করে। গোটা ভবনকে প্যানকেকের মতো চ্যাপ্টা করে ফেলে।’
তিনি বলেন, খোলা জায়গায় ২০০০ পাউন্ড ওজনের বোমা বিস্ফোরণের অর্থ হচ্ছে ১০০ ফুটের মধ্যে থাকা কারোর ‘তাৎক্ষণিক মৃত্যু’। ঐ বোমার প্রাণনাশী ভ্গ্নাংশগুলো ১,২০০ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৩১ অক্টোবর শহরের ভেতরে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ২,০০০ পাউন্ড ওজনের একটি বোমার আঘাতে ১০০ জনেরো বেশি প্রাণ হারান।
বিশেষজ্ঞরা ২০০০ পাউন্ড ওজনের স্পাইস বোমার ভগ্নাংশ চিহ্নিত করেছেন। এতে জিপিএসও লাগানো থাকে যাতে সঠিক জায়গায় আঘাত হানতে পারে। ক্যাস্টনার বলেন, এই বোমাগুলো উৎপাদন করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বিভাগের বিশাল কোম্পানি রাফায়েল। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে দেখেছে এর কিছু প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা হয়েছে।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী নিশানাবিহীন ‘ডাম্ব’ বোমাও ফেলছে। অনেক বিশেষজ্ঞ সামাজিক মাধ্যমে ইসরাইলি বিমান বাহিনীর পোস্ট করা দু’টি ছবি সম্পর্কে বলছেন, এতে দেখা যাচ্ছে জঙ্গি জেট বিমানগুলোতে নিশানাবিহীন বোমা রয়েছে।
এই কৌশল কি কাজ করছে?
ইসরাইল বলছে তাদের দুটি উদ্দেশ্য আছে : হামাসকে ধ্বংস করা এবং তাদের কাছে এখনো আটক ১২৯ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা।
এই যুদ্ধের ১১ সপ্তাহ হয়ে গেল। ইসরাইল বলছে, তারা হামাসের বহু জায়গা এবং শত শত সুড়ঙ্গ পথ ধ্বংস করেছে এবং আনুমানিক ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ হামাস যোদ্ধাদের মধ্য থেকে ৭,০০০ জনকে হত্যা করেছে। ইসরাইলি নেতারা বলছেন, প্রচণ্ড সামরিক চাপই হচ্ছে আরো বন্দীকে মুক্তির একমাত্র উপায়।
তবে বন্দীদের কোনো কোনো পরিবার এ নিয়ে উদ্বিগ্ন যে বোমা বর্ষণের কারণে তাদের প্রিয়জনেরা বিপদে পড়তে পারেন।
গত মাসে এক সপ্তাহব্যাপী অস্ত্র বিরতির সময়ে মুক্তি পাওয়া বন্দিরা বলছেন যে তাদের যারা আটক করেছিল, তারা ইসরাইলের বোমা বর্ষণ এড়ানোর জন্য তাদেরকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতো।
হামাস দাবি করছে যে বহু বন্দী ইসরাইলি বোমার আঘাতেই নিহত হয়েছে, যদিও এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা
Leave a Reply