শীতকালে শরীরে ব্যথা হওয়ার কথা শোনা যায়। ঘাড়েও অনেকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। কোনো কোনো সময় তীব্র ব্যথার সঙ্গে যুক্ত হয় হাতের আঙুলে ঝিনঝিন অনুভূতি। এমনটি হলে এটি সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ও ট্রমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল।
সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস কী
সাধারণ বাংলায় এটাকে বলে ঘাড়ের বাত। অর্থাৎ মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশের কশেরুকাগুলোর মধ্যকার ডিস্ক বা চাকতিসদৃশ তরুণাস্থির ক্ষয়প্রাপ্তি। ঘাড়ের অংশে থাকে সাতটি কশেরুকা। এ কশেরুকাগুলো একটি অপরটির সঙ্গে ডিস্ক ও লিগামেন্ট দ্বারা সংযুক্ত থাকে। মেরুদণ্ডের ঘাড়ের সবচেয়ে বেশি বাঁকানো থাকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ কশেরুকার মধ্যকার ডিস্ক বরাবর। এ ডিস্কে স্পনডাইলোসিস বেশি ঘটে কারণ এ পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। ক্ষয়প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় ডিস্ক তার পানি হারিয়ে ফেলে এবং শুষ্ক হয়ে ওঠে। সুস্থ অবস্থায় ডিস্কগুলো নরম, স্থিতিস্থাপক এবং বেশি মজবুত।
ডিস্কে যখন ক্ষয় শুরু হয় তখন তার নমনীয় তন্তুগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং চাপের ফলে ভেঙে যায়। দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক ক্ষয়ে যায় এবং পাতলা হয়ে যায়। এর ফলে কশেরুকাগুলোর প্রান্তগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে এবং বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা দেখা দেয়। যদি এ তীক্ষè হাড়ের দানাগুলোর কোনোটি স্নায়ুমূলকে খোঁচা মারে তাহলে হাতে তীব্র ব্যথার উদ্রেক হয়। ক্ষয়প্রাপ্ত ডিস্ক তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে যেতে পারে, সেটাকে বলে ‘স্লিপড ডিস্ক’। সে ক্ষেত্রে ডিস্ক স্নায়ুমূলের ওপর চাপ দিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করে। স্লিপড ডিস্ক সাধারণত হয় দুর্ঘটনা, হঠাৎ পড়ে যাওয়া কিংবা ঘাড়ে আঘাতের কারণে। ডিস্কের স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে গেলে ক্ষয়প্রাপ্ত মেরুদণ্ডের নড়াচড়া সহজ হয় না।
স্পনডাইলোসিস সাধারণত ঘটে থাকে ঘাড়ের নিচের চারটি কশেরুকাতে অর্থাৎ চতুর্থ থেকে সপ্তম কশেরুকাতে। ওপরের তিনটি কশেরুকাতে স্পনডাইলোসিস খুব কম হয়। কারণ ওখানটায় খুব একটা চাপ পড়ে না। সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ব্যথা সর্বদা ঘাড়ের পেছন দিকে অনুভূত হয়, কখনোই ঘাড়ের সামনের দিকে অনুভূত হবে না। ব্যথা তীব্র হলে তা কাঁধে এবং বাহুর পেছনের দিকে কনুই পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো কখনো ব্যথা হাতে এবং আঙুলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। করোনারি হৃদরোগ বা এনজিনার ব্যথা বাহুর ভেতরের পাশে অনুভূত হয় এবং সচরাচর তা আঙুলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঘাড়ের নড়াচড়াতে এ ব্যথা বাড়ে না। সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ক্ষেত্রে ঘাড় নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের ব্যথা সাধারণত বাঁ দিকে অনুভূত হয়।
রোগ নির্ণয়
স্পনডাইলোসিস হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এক্সরে পরীক্ষা করা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান অথবা এমআরআই করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের কারণে ঘাড়ে তীব্র ব্যথা হলে সাধারণত নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়-
* ঘাড়ের নড়াচড়া বন্ধ রাখা
* যেসব কাজকর্ম ঘাড়ে নড়াচড়া ঘটায় অবিলম্বে সেসব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ভ্রমণের সময় ঘাড়ে ঝাঁকি লাগে বলে ভ্রমণও বন্ধ রাখতে হবে। যারা অফিস করেন, কিছু দিন তাদের অফিস করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
* ঘাড়ের অসঙ্গত নড়াচড়া রোধ করতে সার্ভাইক্যাল কলার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম কিছু দিন ঘুমের সময়ও সার্ভাইক্যাল কলার পরে থাকা ভালো-এতে ঘুমের মধ্যে অসাবধনতাবশত ঘাড়ের নড়াচড়া প্রতিহত হয়।
* ঘুমানোর সময় ঘাড়টাকে চিৎ হয়ে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থানের চেয়ে ১০-১৫ ডিগ্রি সামনের দিকে বাঁকিয়ে ঘুমান উচিত। একটি স্বাভাবিক আকৃতির বালিশে ঘাড় সামনের দিকে বেশি বাঁকিয়ে থাকে। সুতরাং ঘুমানোর সময় এসব বালিশ পরিহার করতে হবে। ঘাড়ের মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য শোয়ার সময় খুব নিচু বালিশ কিংবা সার্ভাইক্যাল পিলো ব্যবহার করতে হবে। মূলত এ বালিশ থাকবে ঘাড়ের নিচে।
* ব্যথানাশক ওষুধ
ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তির জন্য ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। কখনো কখনো ব্যথা নিবারণের জন্য ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথা কমানোর পর প্রকৃত চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
* গরম সেক
যখনই অস্থিসন্ধি বা হাড়ের গিরাতে ব্যথা হয়, গিরার চারপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে গিড়ার সচলতা কমিয়ে দেয়। মূলত পেশির সংকোচনের দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে শরীর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়-এটাই আমরা করে থাকি সার্ভাইক্যাল কলার পরে। কিন্তু মাংসপেশির সংকোচন বা টান যখন বেশি হয় তখন ব্যথা সৃষ্টি হয়। তাপ হলো মাংসপেশিকে শিথিল করতে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। এ কারণে পেশিতে গরম সেঁক দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ, ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড কিংবা ইনফ্রারেড ল্যাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় গোসলের সময় ঘাড়ে গরম পানি ঢাললে। অধিক পছন্দনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি ও আলট্রাসাউন্ড হিট। এগুলো ফিজিওথেরাপিস্টরা দিয়ে থাকেন।
* ট্রাকশন
ডিস্ক সরে গিয়ে স্নায়ুমূলে চাপ সৃষ্টি করলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ট্রাকশন সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। ট্রাকশনের ফলে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থানগুলো বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে স্নায়ুমূলের ওপর ডিস্কের চাপ শুরু হয়। ট্রাকশনের ওজন বাড়ানো কিংবা কমানো নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। বসে ট্রাকশন দেওয়া যেতে পারে কিংবা শুয়েও দেওয়া যেতে পারে। শোয়া অবস্থায় ট্রাকশন দিলে মাথার দিকের খাট ব্লক দিয়ে ৬-৯ ইঞ্চি উঁচু করে রাখতে হবে। ট্রাকশনের ফলে ব্যথা বেড়ে গেলে ট্রাকশন বন্ধ করে দিয়ে কোনো ত্রুটি আছে কি না তা পরীক্ষা করে সংশোধন করতে হবে।
* মালিশ বা ম্যাসাজ
ঘাড়ের টানটান পেশিগুলোকে শিথিল করতে মালিশ অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। তবে ম্যাসাজ বা মালিশ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে এসব যেন উলটাপালটা করা না হয়। দুই কাঁধে এবং ঘাড়ের মালিশ করতে হবে ধীরে ধীরে। মাংসপেশিকে জোরে মুচড়ে দেওয়া যাবে না, তাতে ক্ষতি হবে।
* ঘাড়ের মাংসপেশি শক্তিশালী করে তোলা
ঘাড়ের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পেশিগুলো যদি শক্তিশালী থাকে তাহলে মেরদণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না, ফলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশিকে শক্তিশালী করা যায়। তবে এসব ব্যায়াম করতে হবে প্রাথমিক ব্যথা মিলিয়ে যাওয়ার পর।
* হাত দুটি একসঙ্গে করে মাথার সামনে ঠেকিয়ে মাথাটাকে সামনের দিকে চাপ দিতে হয়। হাতের ওপর মাথার চাপ বাড়বে, তবে হাত দুটিও মাথার ওপর সমান চাপ দেবে।
* হাত দুটি মাথার পেছনে নিয়ে মাথাটাকে পেছন দিকে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে হাত দুটি যেন মাথার সামনে চাপ দেয়।
* একইভাবে ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিকে ও বাম হাত দিয়ে মাথার দিকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মাথাও সমানভাবে হাতের ওপর চাপ দেবে।
মূলত হাত ও মাথার পরস্পরের দিকে চাপ এমন হতে হবে যেন মাথা বাঁচিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ হাত যত জোরে মাথার দিকে চাপ দেবে, মাথাটাকে তত জোরে বিপরীত দিকে ঠেলতে হবে।
* শক্ত পেশি শিথিল করতে ব্যায়াম
প্রাথমিক ব্যথা সেরে যাওয়ার পর সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের রোগীরা শক্ত ঘাড়, পিঠের উপরি অংশ ও কাঁধের পেশি শিথিল করতে কিছু ব্যায়াম করতে পারেন-
* মাথাটাকে বামে ও ডানে ঘোরান।
* মাথাটাকে বাঁচিয়ে সামনের দিকে আনবেন। তারপর পেছনের দিকে নেবেন।
* মাথাটাকে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরাবেন।
* কাঁধ দুটি ওপরের দিকে তুলবেন ও নামাবেন। তারপর কাঁধ দুটিকে ঘোরাবেন।
* হাত দুটিকে নিজের দুই কাঁধের ওপর স্থাপন করে কনুই দুটি বৃত্তাকারে ঘুরাবেন।
Leave a Reply