কুরআন মাজিদের ১১৪টি সূরার মধ্যে যে সূরাটি মুমিনরা সবচেয়ে বেশি পাঠ করেন, তা হলো সূরা ফাতিহা। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রত্যেক রাকাতে মুমিনরা সূরা ফাতিহা পাঠ করেন। এ সূরায় মুমনিরা তাদের প্রভুর কাছে যে জিনিসটি চান, তা হলো- সিরাতুল মুস্তাকিম।
সিরাতুল মুস্তাকিম কী : সিরাত অর্থ- রাস্তা, পথ। আর মুস্তাকিম অর্থ- সরল, সঠিক ও সোজা পথ, যার কোনো জায়গা বা কোনো অংশ বাঁকা নয় তথা সিরাতুল মুস্তাকিম হলো ওই সরল ও সঠিক পথ যার কোনো শাখা-প্রশাখা নেই। জারির ইবনে আতিয়া বলেছেন, বিশ্বাসীদের নেতা রয়েছেন সেই পথে যা সব সময়েই সরল ও সঠিক। আর অন্যান্য পথে রয়েছে বক্রতা। ইমাম তাবারি বলেন, আরবরা সিরাত শব্দটি বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে ব্যবহার করে থাকে, চাই তা সৎ হোক বা অসৎ হোক। কুরআন মাজিদে যে সরল-সঠিক পথের কথা বলা হয়েছে, তা হলো ইসলাম (তাবারি-১/১৭০) রাসূল সা: বলেন, আল্লাহ তায়ালা সিরাতুল মুস্তাকিমের একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, তা হলো- সিরাতুল মুস্তাকিমের দু’টি প্রাচীর রয়েছে, তাতে কয়েকটি দরজা রয়েছে। দরজাগুলোর ওপরে পর্দা লটকানো রয়েছে। সিরাতুল মুস্তাকিমের প্রবেশদ্বারে সদা একজন আহ্বানকারী নিযুক্ত রয়েছে। সে বলছে, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা সবাই এই সোজা পথ ধরে চলে যাও, আঁকাবাঁকা পথে যেও না। ওই রাস্তার ওপর একজন আহ্বানকারী রয়েছে। এ দরজাগুলোর কোনো একটি কেউ খুলতে চাইলে সে বলে, সাবধান তা খুলবে না, যদি খুলে ফেল তাহলে সোজা পথ থেকে সরে পড়বে। সিরাতুল মুস্তাকিম হচ্ছে ইসলাম। আর প্রাচীরগুলো আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ, আর প্রবেশদ্বারে আহ্বানকারী হলো কুরআন। আর রাস্তার ওপর আহ্বানকারী হলো আল্লাহর ভয় যা প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেষ্টারূপে অবস্থান করে থাকে। (মুসনাদ আহমদ-৪/১৮২) সিরাতুল মুস্তাকিমের গন্তব্যস্থল হলো জান্নাত, যেখান থেকে আমাদের আদি পিতা হজরত আদম আ: ও মা হাওয়া আ: দুনিয়াতে এসেছিলেন। সে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে আগমনের সময় আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, যারা হিদায়াত গ্রহণ করবে তারা সোজা পথ ধরে আবার এখানে ফিরে আসতে পারবে। পৃথিবী থেকে যে পথ ধরে আবার জান্নাতে ফিরে যাওয়া যাবে তা হলো- সিরাতুল মুস্তাকিম বা সোজা পথ। আর এ পথের গন্তব্যস্থল হলো জান্নাত। এক কথায় আল্লাহর দ্বীন, ইসলাম, কুরআন, রাসূলের আদর্শ এবং ইবাদতের ওপর সিরাতুল মুস্তাকিম কথাটি প্রযোজ্য। (হেদায়াতুল কুরআন ই.ফা.বা: প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৫)
এ পথের পথিক কারা : সিরাতুল মুস্তাকিমের পথিক হলো- চার শ্রেণীর মানুষ।
১. নবী-রাসূলগণ : তারা হলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত ব্যক্তি। তারা সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে মুক্ত এবং স্বীয় প্রভুর আদেশ-নিষেধ পালনে সদা ব্যস্থ। আল্লাহ তায়ালার হুদুদ বা সীমারেখার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই। তাদের পথ হলো সিরাতুল মুস্তাকিম। তারা নিজেরা এ পথে চলেছেন এবং উম্মতকেও এ পথে পরিচালনা করেছেন। উম্মতকে এ পথে পরিচালিত করতে গিয়ে দু’জন নবী তথা হজরত আদম আ: ও হজরত সুলাইমান আ: ছাড়া সব নবী-রাসূলকে মানবরূপী শয়তানদের হাতে মার খেতে হয়েছে। সাইয়েদুল মুরসালিন, বিশ্বনবী সা:-কে পর্যন্ত রক্ত দিতে হয়েছে। সুতরাং সিরাতুল মুস্তাকিম একটি রক্তপিচ্ছিল পথ।
২. সিদ্দিকগণ : সিদ্দিক অর্থ-বিশ্বস্ত, বিশ্বাসী যারা সত্য গ্রহণ ও মানার ব্যাপারে মনের মধ্যে কোনো সঙ্কোচবোধ করেন না, সত্য বলে জানা ও বোঝার সাথে সাথে তা গ্রহণ করেন তারাই সিদ্দিক। যেমন- হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:। মহানবী সা: যখন সাহাবিদের কাছে মিরাজের বর্ণনা দেন, তখন অনেকেই অবিশ্বাস না করলেও চিন্তায় পড়ে যান ও মনে প্রশ্ন জাগে- এক রাতের মধ্যে বাইতুল মুকাদ্দাসে গিয়ে নবী-রাসূলদের সালাতের ইমামতি করা, জান্নাত-জাহান্নাম দেখা, আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ ইত্যাদি কিভাবে সম্ভব? কিন্তু হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: শোনা মাত্রই সত্য বলে বিশ্বাস করেন। তার মতো গুণের অধিকারী যারা তারাই সিদ্দিক। তাদের পথচলাও সহজ নয়; বরং বন্ধুর।
৩. শহীদগণ : সিরাতুল মুস্তাকিমের তৃতীয় পথিক হলেন শহীদগণ। সিরাতুল মুস্তাকিমে চলতে গিয়েই তাদের জীবন দিতে হয়েছে। তারা দুনিয়ায় কোনো জুলুম-নির্যাতন করেননি, কারো সম্পদ জবরদখল করেননি, ব্যভিচার করেননি, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অপকর্ম করেননি। তাদের একটিই অপরাধ ছিল, যে কথা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এ কারণে যে, তারা মহিমাময় পরাক্রান্ত প্রশংসাভাজন আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল’ (সূরা আল-বুরুজ-৮)।
৪. সালেহিন বা নেককারগণ : সালেহিন হলো ওই সব ব্যক্তি যারা আল্লাহকে প্রতিপালক বলে বিশ্বাস করে এবং বাস্তব জীবনে এ বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। জীবন থেকে স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও স্বেচ্ছাচারিতা দূর করে আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশকে হৃদয়ে স্থান দেয়। সদা সে সিরাতুল মুস্তাকিমে চলার চেষ্টা করে, অসৎ, অন্যায় ও ভ্রান্তপথ পরিহার করে। এ পথে চলা কষ্টকর হলেও সে এ পথ ত্যাগ করে না। কারণ এ পথই আসল পথ, এ পথই মুক্তির পথ ও আল্লাহর পথ।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আলজামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী
Leave a Reply