1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০১ পূর্বাহ্ন

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর এবং এর প্রাসঙ্গিকতা

মোহাম্মদ ছাইয়েদুল ইসলাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০২২

মার্কিন সরকারের তৃতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তার ঝটিকা এশিয়া সফরসূচিতে হঠাৎই তাইওয়ানকে যুক্ত করে বিশ্ব রাজনীতিতে নুতন এক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে পেলোসির অফিস তার ভ্রমণের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আগে প্রকাশ করেনি। হোয়াইট হাউস পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছিল। এমনকি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, পেন্টাগন মনে করে পেলোসির তাইওয়ান সফর যাওয়া ভালো ধারণা নয়, এবং তিনি নিজেও জানেন না বর্তমান পরিস্থিতি কী। তার এই সফরের উদ্দেশ্য, প্রাপ্তি সব কিছুই নিয়েই এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। তবে পেলোসি দাবি করেছেন যে, তার পদক্ষেপটি তথাকথিত তাইওয়ানের ‘গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থনের অভিব্যক্তি।’

এপ্রিলের প্রথম দিকে, ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান আসার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত, করোভাইরাস নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ায় মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে তাইওয়ানসহ এশিয়ায় তার পরিকল্পিত সফর বাতিল করা হয়। এর কয়েক মাস পর তিনি আবার তাইওয়ান সফরের কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, চীনের কঠোর বিরোধিতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুতর উদ্বেগ উপেক্ষা করে স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ান সফর করেন। ২ আগস্ট সন্ধ্যায় উভয় রাজনৈতিক দলের মার্কিন কংগ্রেসের ছয় সদস্যের একটি দল তাইপেই সোংশান বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সফরকারী দলটি বুধবার (৩ আগস্ট) তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের সাথে সাক্ষাৎ করে ওই দিন সন্ধ্যায় তাইওয়ান ত্যাগ করেন।

পেলোসির তাইওয়ান সফরের ফলে, ১৯৯৭ সালের পর মার্কিন সরকারের তাইওয়ান সফরের বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন এবং তিনি ২৫ বছরের ব্যবধানে তাইওয়ান সফরকারী মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের প্রথম স্পিকার। ১৯৯৭ সালে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের তৎকালীন স্পিকার নিউট গিংরিচ কংগ্রেসের সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে তাইওয়ান সফর করেন এবং তৎকালীন তাইওয়ানের নেতা লি টেং-হুই তাকে স্বাগত জানান। নিউট গিংরিচ তখন বিরোধী রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু ন্যান্সি পেলোসি বাইডেনের অধীনে ক্ষমতায় থাকা ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্তর্গত, যা চীন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় পশ্চাদপসরণ, এমনকি সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাবে তার এই পদক্ষেপ। কারণ, আজকের চীন ২৫ বছর আগের চীন নয়। সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনের সংকল্প ও বিশ্বাস বরাবরের মতোই দৃঢ়। চীন যদি মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিকীকরণ করছে এবং এটিকে চীনের বিরুদ্ধে একটি ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে, তাহলে চীন অবশ্যই হস্তক্ষেপ করবে এবং আমরা এটি বন্ধ করতেও পারব না।

বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত যে একমাত্র চীন রয়েছে এবং তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল ১৯৪৩ সালের কায়রো ঘোষণা এবং ১৯৪৫ সালের পটসডাম ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, ১৯৭১ সালের জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এক-এও বলা হয়েছে। রেজোলিউশন ২৭৫৮ এটি স্পষ্ট করে যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার যা সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৮১টি দেশ এক-চীন নীতির ভিত্তিতে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি বিবৃতিতে একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় যে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার চীনের একমাত্র আইনসঙ্গত সরকার।’

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ১৬০টিরও বেশি দেশের মানুষ চীনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার প্রচেষ্টার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। চীন আধিপত্য, হস্তক্ষেপ ও বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন পেয়েছে। তারা মনে করেন, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির চীনের তাইওয়ান অঞ্চলে সফর চীনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। আন্তর্জাতিক আইন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক নিয়মগুলিকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপকভাবে নিন্দা করা উচিত।

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে রুশ নিরাপত্তা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার এই সফর একটি নির্লজ্জ উস্কানি যা সরাসরি এশিয়ার নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এক-চীন নীতি মেনে চলার দাবি করে, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে উসকানি দিতে সম্ভাব্য সবকিছু করছে। মেদভেদেভ আরও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেলোসির তাইওয়ান সফর আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এবং এ থেকে সুফল পেতে।

চীনে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাক্স বাকাস সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পেলোসির তাইয়ান সফর ‘অপ্রয়োজনীয়, বিবেকহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি হলো তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা কমানো। পেলোসির আসলেই তাইওয়ানে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তার এই পদক্ষেপ চীনের মূল ভূখণ্ডের জন্য একটি উসকানি। তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন করার জন্য তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’-এর সমর্থনকে ধীরে ধীরে চাপ দিচ্ছেন, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমরা আগুন নিয়ে খেলছি, পেলোসি তাইওয়ানকে ‘স্বাধীন দেশ’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার খুব কাছাকাছি আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। একবার আমরা সেখানে পৌঁছলে, আমরা মূল্য পরিশোধ করব। এটি কেবল দুঃখজনক, পেলোসির পদক্ষেপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চীনাদের সামনে খুব দুর্বল দেখায়। কারণ, তিনি পেলোসিকে তাইওয়ান যেতে বারণ করেছিলেন, কিন্তু সে যাইহোক চলে গেছে। পেলোসি রাষ্ট্রপতি নন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তাইওয়ান সফর করতে বেছে নিয়েছেন।

কানাডিয়ান ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের ফেলো ইয়েভেস এংলার বলেন, পেলোসির এই পদক্ষেপের একমাত্র ব্যাখ্যা হলো আমেরিকার নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে সারা বিশ্বের দেশগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার আছে, এবং আমি মনে করি পেলোসির পদক্ষেপ সম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক। তার এটি করা উচিত নয়।
ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেই পটভূমিতে বাংলাদেশ এক-চীন নীতির অবস্থানে অটল থাকার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে বলেছেন, এক চীন নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনার নিরসন চাইছে। ‘আমরা এক চীন নীতিতে বিশ্বাস করি।’ চীনের সাথে সম্পর্কের কারণে অদূর ভবিষ্যতেও তাইওয়ানের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার চিন্তা নেই- বাংলাদেশ তাদের এই অবস্থান স্পষ্টভাবেই বলছে।

পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে,’ পেলোসি বেপরোয়া, বিপজ্জনক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু করছে। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলেছে, পেলোসির তাইওয়ান সফর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ থেকে ‘কৌশলগত বিশৃঙ্খলা’-এর দিকে নিয়ে গেছে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলেছে, পেলোসির তাইওয়ান সফর অযৌক্তিক, এবং তার সফরের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বিশ্বের মানচিত্রে একটি চীন আছে, তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার যা সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে। এক-চীন নীতি হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাধারণ ঐকমত্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক নিয়ম। চীনের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, তাইওয়ান প্রণালীর শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করে, এবং তাইওয়ানের স্বাধীনতার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে সহযোগিতা করতে ন্যান্সি পেলোসির এই সফরের আসল উদ্দেশ্য কী?

পেলোসির তাইওয়ান সফর শুধু তার ইচ্ছা হতে পারে না, কারণ তিনি তার পেছনে মার্কিন সরকারের মনোভাবকে প্রতিনিধিত্ব করেন। অতএব, এই সুপরিকল্পিত ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শের ফল হতে পারে। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের বর্তমান স্পিকারের তাইওয়ান সফরের অর্থ কী তা তার খুব ভালোভাবে জানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের আগে, চীন কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ বা বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে চায় না। তাই ন্যান্সি পেলোসি এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তার তাইওয়ান সফরে আসার পরিকল্পনা নেন।

আমরা সকলেই জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক মেরুকরণের বর্তমান মাত্রা গভীরতর হচ্ছে, এবং দুটি দল রাজনৈতিক ইস্যুতে ভোটের জন্য লড়াই করছে। পেলোসি তাইওয়ানের এই সফর সম্পর্কে এত ইতিবাচক এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচন শুরু হতে চলেছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টির বেশি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিএনবিসির সর্বশেষ জরিপ দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সামগ্রিক সমর্থন এবং তার অর্থনৈতিক নীতিগুলির প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থনের হার সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে, যা তার দুই পূর্বসূরিদের চেয়েও খারাপ।

কোভিড মহামারীর একাধিক প্রভাব, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির হার বিস্ফোরিত হয়েছে। তাছাড়া, মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার, অবৈধ অভিবাসন সমস্যা, তেলের দাম, এবং বন্দুক নিয়ন্ত্রণ ইস্যু সরকারের প্রতি অভ্যন্তরীণ জনগণের অসন্তোষ আরো গুরুতর হয়ে উঠেছে। নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হেরে গেলে, পেলোসির ডেমোক্র্যাটিক আইন প্রণেতারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে, তখন পেলোসির প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার হবার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। পেলোসি আজীবন প্রতিনিধি পরিষদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চান। অবসর নেয়ার আগে, তিনি একটি বড় ভোট পাওয়ার আশা করছেন এবং এটিকে তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যেতে চান। তাইওয়ান সফরের এসে ‘তাইওয়ান কার্ড’ খেলে মার্কিন জনসাধারণের কাছে চীনের প্রতি তার কঠোর অবস্থান দেখাচ্ছেন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনকে উন্নত করার চেষ্টা করছেন। এর সাথে হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকারের আসনটি ধরে রাখতে চান।

পেলোসির তাইওয়ান সফর ক্রমাগত চীনের মূল ভূখণ্ডের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা এবং তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদীর কাছে মার্কিন অস্ত্রের নতুর বাজার তৈরী করা। এ বিষয়টি একটি ‘ভাঙা উইন্ডো প্রভাব’ সৃষ্টি করবে। ভবিষ্যতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টেরও তাইওয়ান সফর করার সম্ভাবনা থাকবে। যখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাইওয়ানে আসবেন, তখনই তারা তাইওয়ান প্রণালী সঙ্কটকে আরো নুতন এক মাত্রায় নিয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে, তাইওয়ানের স্বাধীনতার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরো শক্তিশালী হতে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কিনবে। আমেরিকান অস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রচুর অর্থ উপার্জন হবে। সম্প্রতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে অস্ত্র সহয়তা দিয়ে তাদে অস্ত্র ব্যবসা চাঙ্গা রেখেছে।

২০০৭ সালে থেকে তাইওয়ান তাৎপর্যপূর্ণভাবে তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দেশটির অস্ত্র কেনাও বেড়ে যায়। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রির তিনটি পৃথক চুক্তি হয়। তার উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সাথে ১৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখন পর্যন্ত তাইওয়ানের সঙ্গে মাত্র এক বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। কিছু দিন আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ানের মধ্যে অস্ত্র লেনদেনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী সংস্থা ইউএস-তাইওয়ান বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে, যেখানে অনুমান করা হয় আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাইওয়ানের মোট সামরিক ক্রয় ৩৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

ন্যান্সি পেলোসি স্বশাসিত দ্বীপটিতে তার ঝটিকা সফরের ফলে, চীন তাইওয়ানের চারপাশে সমুদ্র ও আকাশে ব্যাপক পরিসরে সামরিক মহড়া শুরু করে। পেলোসি রাজধানী তাইপেই ত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পরই এই মহড়া শুরু করে বেইজিং। দ্বীপটিকে ঘিরে ছয়টি অঞ্চলে এ মহড়া চালানো হয়। পেলোসির তাইওয়ান বিতর্কিত ক্ষুব্ধ বেইজিং ওয়াশিংটনের সাথে বেশ কয়েকটি সংলাপ ও সহযোগিতা চুক্তি বাতিল করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রতিরক্ষা সংলাপ। তাছাড়া, পেলোসির গুরুতর উস্কানির প্রতিক্রিয়ায় চীনের প্রাসঙ্গিক আইন অনুসারে পেলোসি এবং তার পরিবারের সদস্যদের উপর নিষেধাজ্ঞা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

চীনা স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই উল্লেখ করেছেন, মার্কিন পক্ষ তাইওয়ান ইস্যুতে তার প্রতিশ্রুতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, নির্লজ্জভাবে আগুন নিয়ে খেলছে এবং ১৪০ কোটি চীনা জনগণের শত্রু হয়ে উঠেছে। তাইওয়ান থেকে পেলোসির প্রস্থান কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সমস্যা নয় বরং চীনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার সাথে সম্পর্কিত একটি সমস্যা।

তাইওয়ান প্রণালীতে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সঙ্ঘাত হলে, যুক্তরাষ্ট্রসহ চীনের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সুবিধা নেবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র জাপান বর্তমানে একটি নির্বাচনের সম্মুখীন হচ্ছে, এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পরবর্তী সময়ে জাপানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। তাছাড়া, চীনের সাথে জাপানের ঐতিহাসিক দ্বন্ধ বিদ্যমান রয়েছে। অতীতে এই দুটি দেশ ভয়ংকর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯৩০ এর দশকে, জাপানি সাম্রাজ্য চীনে আক্রমণ করার জন্য তাইওয়ানকে একটি স্প্রিংবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তাইওয়ান প্রণালীতে সামরিক সঙ্ঘাত জাপানের জন্য লাভজনক দিক, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার উপর দখলদারিত্ব শিথিল করতে সাহায্য করবে এবং জাপান স্ব-স্বাধীন উন্নয়নের স্থান প্রসারিত করবে। ধারণা করা হচ্ছে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ জোরদার করার জন্য জাপান এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পশ্চিম চীনে ভারতের উপর জয়ী হতে চাইবে। পশ্চিম চীনের চীন-ভারত সীমান্তে চীনের উপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করবে। ভারত এখন ডলারের সঙ্কটে ভুগছে, যার ফলে ডলারে লেনদেন না করে চীনের সাথে চাইনিজ মুদ্রা ইউয়ানে বাণিজ্য নিষ্পত্তি করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট চীন-ভারত-রাশিয়া ত্রিভুজাকার বাণিজ্য শক্তি বাণিজ্যের ডি-ডলারাইজেশন এবং নিষ্পত্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যখন অন্য কয়েকটি প্রধান পণ্য উৎপাদনকারী দেশ ঘাটতিতে রয়েছে, এই বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত, চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। চীন আসলে ভারত-চীন সীমান্তে ভারতের উপর প্রবল সামরিক চাপ বজায় রেখেছে, যাতে ভারত তাড়াহুড়া করে কিছু করার সাহস না করে। তাই ভারত এবার চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবদান রাখবে না বলে মনে হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপর কৌশলগত চাপ অব্যাহত রাখবে।

দক্ষিণ কোরিয়ার আমেরিকাপন্থী দল ক্ষমতায় এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা আগের চেয়ে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তাছাড়া, অতীতে দুই কোরিয়ার যুদ্ধে চীনা সেনাবাহিনী উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। চীনের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সীমানা বিরোধ রয়েছে। অন্যদিকে, ভবিষ্যতে উত্তর কোরিয়ার প্রতি রাশিয়ার বৃহত্তর সমর্থনের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া দোনেস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে দক্ষিণ কোরিয়া এবং আমেরিকার চলমান বিবাদ কারো অজানা নয়। তাই ভবিষ্যতে তাইওয়ান প্রণালীতে দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আমরা যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাইওয়ানে পেলোসির সফরের কারণে অনিবার্যভাবে সৃষ্ট সামরিক সঙ্ঘাতের কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ আংশিকভাবে ইউরোপ থেকে তাইওয়ান প্রণালীতে স্থানান্তরিত হবে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে ভালো নয়। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার সাথে আপস করার সম্ভাবনা বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্য দিকে, রাশিয়া চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দীর্ঘ দিনের মিত্রতা রয়েছে। আমেরিকান কর্তৃত্ব কমাতে রাশিয়া ও চীন দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের ভিত্তিতে একটি মজবুত জুটি গড়ে তুলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চীন রাশিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে। তাইওয়ান প্রণালীতে সংঘাত বাড়লে, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার্থে চীনের মনোযোগ তাইওয়ান প্রণালীতে স্থানান্তরিত হবে।

তাইওয়ান ইস্যুতে চীন কখনই পিছপা হবে না! চীন ভালো করেই জানে, একবার পিছিয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজেই সফল হবে, ‘সসেজগুলো’ কাটার আরো সুযোগ পাবে। একসময়, অন্য পশ্চিমা দেশগুলিও চীনের বিরুদ্ধে এই নীতি অনুসরণ করবে এবং তাইওয়ান ইস্যুকে আরো আন্তর্জাতিকীকরণের দিকে নিয়ে যাবে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার খেলায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সবসময় ‘তাইওয়ান তাস’ খেলে। চীনের পুনর্মিলন রোধ করার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ করছে এবং তাইওয়ান নীতির বিরুদ্ধে ‘সসেজ কাটার’ কৌশল চালাচ্ছে। এশিয়াসহ তাইওয়ান প্রণালীর শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, মার্কিন পক্ষের উচিত এক-চীন নীতি এবং তিনটি চীন-মার্কিন যৌথ ইশতেহার মেনে চলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিনিময় বন্ধ করা এবং সমর্থন না করার মার্কিন প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া।

লেখক : চিয়াংশি ইউনিভার্সিটি অফ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স-এর ডক্টরাল ফেলো, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বেল্ট অ্যান্ড রোড রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, এবং চীনে বসবাসরত বাংলাদেশী সাংবাদিক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com