রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এ পর্যায়কে বিশেষজ্ঞরা ভ্লাদিমির পুতিনের ‘শীতকালীন কৌশল’ বনাম ন্যাটোর ‘গ্রীষ্মকালীন কৌশল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বাস্তবতার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এ যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রল ও খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। দ্য টাইমস পত্রিকা গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, এ বছরের শেষের দিকে রাশিয়া তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় জ্বালানির দাম আরো একদফা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে এবং তখন ইউরোপকে নতুন করে মূল্য দিতে হবে বলে হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা মনে করছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বড় অর্থনীতিগুলোর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে তীব্র খাদ্যসংকটও দেখা দিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ন্যাটো ও ইইউ ইউরোপে রাশিয়ার তেল রফতানি কমানোর যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তার ফল হিসেবে শিগগিরই তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে ধারণা করা যায়, যুদ্ধ শিগগিরই থামছে না বরং আরো সম্প্রসারিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতির কী অবস্থা হবে সে প্রসঙ্গে আলোচনা করব এই প্রবন্ধে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহ অথবা মন্দার প্রভাব কোনো দেশের ওপর বিশেষ করে আমদানিনির্ভর উন্নয়নশীল দেশে আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্স এই তিনভাবে পড়ে। প্রথমে আমরা রফতানি নিয়ে আলোচনা করি। এটি আশার কথা, দেশের পণ্য রফতানি ২০২১-২২ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে আরো ২০৮ কোটি ডলার বেশি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় চার লাখ ৮৬ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার সমান। এই আয় গত অর্থবছরের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।
এখন আমরা দেখব, প্রকৃত অর্থে আমাদের রফতানি বেড়েছে কিনা; বিশেষজ্ঞদের মতে বাড়েনি। একটি উদাহরণ দিয়ে বলি, গত বছর যে ট্রাউজারটা ছয় ডলারে বিক্রি হতো সেখানে ১০ সেন্ট লাভ হতো। সেই ট্রাউজারটা এখন সাত ডলারে বিক্রি করে লাভ হচ্ছে সেই ১০ সেন্ট। কারণ এই ট্রাউজারটা বানানোর জন্য যে সুতা ও তুলার দরকার ছিল তার ফোরটি পার্সেন্ট দাম বেড়েছে। আমরা যদি শুধু এক ইউনিট নিয়ে কথা বলি তাহলে দেখা যাবে, ছয় ডলারের ট্রাউজার সাত ডলারে বিক্রি হলে ন্যাশনাল এক্সপোর্ট এক ডলার বেড়েছে। কিন্তু এই সাত ডলার পেতে গিয়ে যে, ছয় ডলার ইম্পোর্ট করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা যে এক্সপোর্ট প্রবৃদ্ধি শতকরা ৩৭ থেকে ৪০ ভাগ বলছি সেটা স্ফীত প্রবৃদ্ধি, প্রকৃত প্রবৃদ্ধি নয়।
কারণ পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ফলে ক্রেতা ক্রয় দাম কিছু বেশি দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৯ সালে দেশের এক্সপোর্ট ছিল ৩২ বা ৩৩ বিলিয়ন ডলার। সেই ব্যবসায় যদি ৪০% আপ চার্জ যোগ করেন তাহলে এক্সপোর্ট ১৫-১৬ বিলিয়ন বেড়ে ৫০ বিলিয়ন ডলারই হয়। অর্থাৎ গত তিন-চার বছরে প্রকৃত রফতানি বাড়েনি; আসল এক্সপোর্ট হয়েছে ৩৩-৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য; আমাদের কিন্তু কোয়ান্টিটি বাড়েনি। সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট বাড়েনি। যুদ্ধ পরিস্থিতির পঞ্চম মাসে এসে বরং রফতানি কমার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট পণ্য রফতানির প্রায় ৮২ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে। তার পরের চার শীর্ষ রফতানি খাত হচ্ছে হোম টেক্সটাইল, চামড়া আর চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। এর মধ্যে খাদ্য এবং হোম টেক্সটাইল ছাড়া বাকি সব সেক্টরের রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ফলে মানুষ অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাইরে কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তার নেতিবাচক প্রভাব পরিষ্কার হবে। একদিকে ক্রয় আদেশ কমছে, অন্য দিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। সব মিলিয়ে, তাই দুশ্চিন্তায় পড়ছেন রফতানিকারকরা।
এখন আসুন, আমদানি বিষয়ে। বাংলাদেশের ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৭৮৭ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরের পণ্য আমদানি ব্যয় ছিল ছয় হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে পণ্য আমদানিতে ব্যয় ৩৩ শতাংশ বা দুই হাজার ২৩২ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের প্রাথমিক হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ কোটি ৯৪ লাখ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ পণ্য আমদানি ৫৬ লাখ টন বা ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ কমেছে। আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; তার পরও তেমন আমদানি কমছে না অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় রফতানি আয় কমছে। আমদানিতে জোয়ারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৭ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে ধারণা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদায়ী অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
ধারণা করা হচ্ছে, নতুন অর্থবছরে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি কমে ১৩ শতাংশে নেমে আসবে। আমদানি ব্যয় বাড়বে ১২ শতাংশ; ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে দিন যত যাচ্ছে, অর্থনীতিতে সঙ্কট ততই বাড়ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে অন্তত ১৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ যদিও বাস্তব মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা করেন অভিজ্ঞরা।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে যদিও আইএমএফের হিসাব মতে, রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবেই বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়, সেই হিসেবে বাংলাদেশ এখনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। তবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি।
রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তার মধ্যে জ্বালানি সঙ্কট মেটানোর জন্য বিদ্যুতে লোডশেডিং অন্যতম। এই লোডশেডিংয়ে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়ে দেশের রফতানির জন্য বুমেরাং হতে পারে। এ ছাড়াও লোডশেডিংয়ের কারণে বেশির ভাগ জায়গায় ডিজেলচালিত জেনারেটর চালানোর ফলে জ্বালানি খরচ আরো বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া সব ধরনের আমদানি নিরুৎসাহিত নয়, নিয়মের মধ্যে থেকে বন্ধ করা প্রয়োজন। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করার কথা বলা হলেও এখনো ব্যাপকভাবে কম প্রয়োজনীয়, এমনকি অপ্রয়োজনীয় কাজে বিদেশ ভ্রমণের খবর বিভিন্ন পত্রিকায় আসছে।
রিজার্ভের চাপে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সরকারিভাবেই দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ; খোলাবাজারে এই অবমূল্যায়ন আরো অনেক বেশি। ব্যাংক আমদানির দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, ফলে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে।
সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। আলোচিত সময়ে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৮৮১ কোটি ডলার। একই সময়ে সেবা খাতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ২৩৪ কোটি ডলার। ফলে সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৫৩ কোটি ডলার যা আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) একই সময়ে ছিল ২৫৩ কোটি ডলার।
গত ৩০ জুন ২০২১-০২২ অর্থবছর বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থাৎ ২০২০-২০২১ অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের ঊর্ধ্বমূল্য আমদানি খরচ বাড়ার একটি কারণ। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আমদানি ব্যয় বাড়লেও এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না রফতানি। করোনাভাইরাস নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঘাত তো লেগেই আছে। সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি পলিসি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, আমরা যদি সাশ্রয়ী না হই আমাদের সামনে ভয়াবহ সময় আসছে। দিন শেষে কিন্তু যে ক্রাইসিস ডিমান্ড ও সাপ্লাইয়ের মধ্যে যে গ্যাপ হয়ে গেছে সে গ্যাপ পূরণ করার জন্য আমাদের ইমিডিয়েটলি পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের অপচয় তো বন্ধ করতে হবেই পাশাপাশি কম প্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, যেমন বেপরোয়া গাড়ি চলাচল, এসিতে বসে সারাক্ষণ অফিস করা ইত্যাদি।
উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা কৃষি উৎপাদন। সুতরাং এই সেক্টরের সার, বীজ, পানি সরবরাহ যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। বিশেষ করে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে আমন ধানের পানি সরবরাহ কোনোভাবেই যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সর্বোপরি শ্রীলঙ্কা যে ভুলটা করেছে সেই ভুলের দিকে খেয়াল রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শ্রীলঙ্কান অর্থনৈতিক সঙ্কটের পেছনে রাজনৈতিক সঙ্কটও ছিল; দীর্ঘদিন জনমতের বিপক্ষে সরকারের থাকা পরিবারটা ভাবতেই পারেনি শ্রীলঙ্কার মানুষ বিপ্লব ঘটাবে। আমাদের রাজনীতিও পরিবারকেন্দ্রিক।
সুতরাং সাবধান হতে হবে, না হয় আমাদেরও শ্রীলঙ্কার মতো ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্য-জীবন যাপন। এর চেয়েও চ্যালেঞ্জিং হলো, দেশের বিরোধী মত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে কেবল বৈশ্বিক কারণ মনে না করে সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, লুটপাট, অব্যবস্থা এবং অপ্রয়োজনীয় অথবা কম প্রয়োজনীয় বৈদেশিক ঋণ নেয়ার কারণে মনে করছে, ফলে তারা সরকারকে সহযোগিতা না করে বরং হাতে তালি দিচ্ছে; অথচ এই সময় প্রয়োজন সবাই মিলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা, অন্যথায় ভয়াবহ মন্দায় পড়তে পারে দেশ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
Leave a Reply