বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ ১৯৭১ প্রদত্ত ইতিহাসের অনন্য ভাষণটি অধিকারবঞ্চিত বাঙালির শতসহস্র বছরের সংগুপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের উচ্চারণে সমৃদ্ধ। মাত্র উনিশ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি এত কথা অমন অমোঘ তীক্ষতা, সাবলীল ভঙ্গি, বাহুল্যবর্জিত কিন্তু গভীরভাবে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় কেমন করে বলতে পারলেন সে এক বিস্ময় বটে! ভাষণের মূল কথা যদি খুঁজি তাহলে দেখা যায় পূর্ব বাংলার মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস ও অধিকারহীনতার বিষয় এতে দীপ্র হয়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে বাঙালির সার্বিক মুক্তি সম্ভব—এই বক্তব্যই বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতাশৈলীর অতুলনীয় ভঙ্গিতে কখনো আবেগ, কখনো যুক্তি, কখনো প্রশ্ন বা ইচ্ছাকৃত জোরালো পুনরুক্তির মাধ্যমে সোচ্চার, কিংবা বিশেষ স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে সংগত কারণেই কৌশলময় ভাষা বা ইঙ্গিতে শ্রোতাদের মনে গেঁথে দিয়েছেন।
দুই.
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও অসাধারণত্ব বহুমাত্রিক। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিচার করলেও এ ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কেউ কেউ এ ভাষণকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ স্পিস বা মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। এই তুলনাকে যথাযথ মনে হয় না। আমাদের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ওই সব ভাষণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে একটা জাতি গঠন প্রক্রিয়ার পূর্ণতা এবং একটা জনগোষ্ঠীর শত শত বছরের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও বিপুল আত্মত্যাগের ইতিহাস যুক্ত রয়েছে। দার্শনিক নিেশ রাষ্ট্র গঠনকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক কর্ম বলে আখ্যাত করেছেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র গঠনের এই মহৎ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন বলেই আমরা বলি তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং বাঙালি জাতির পিতা।
তিন.
এই ভাষণের মাধ্যমে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয়-ত্রাস এবং আশা ও সম্ভাবনায় উদ্বেল সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মাত্র ১৯ মিনিটের এক জাদুকরি ভাষণে রাজনৈতিক চেতনার একই স্তরে এনে স্বাধীনতার জন্য মরণপণ অঙ্গীকারে দীপ্ত মুক্তি সেনানিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির মেলা ভার। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে আজাদ-হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন : ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ নেতাজি সফল হননি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে, ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লা’—উক্তিকে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত করেছেন। ৭ই মার্চের অনন্যসাধারণ ভাষণ, তাঁর এবং শুধু তাঁরই এক চিরকালীন মাস্টারপিস।
চার.
কী নেই সেই সংক্ষিপ্ত ভাষণে? বাঙালি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ধারাবাহিক করুণ ইতিহাস আছে, তা বর্ণনা করার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া আছে আবেগ, রক্ত ঝরানোর নির্মম স্মৃতি এবং তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক আশা-প্রত্যাশার ন্যায্যতা, আছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং যুক্তির জোরালো উপস্থিতি। এই সব মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্ব, গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা এবং নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার অর্জন ও আর্থ-সামাজিক মুক্তির এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে। এসব গুণের জন্য শুধু বাঙালি নয়, গোটা বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ পরিস্থিতির প্রকৃত সত্য অনুধাবনে সহানুভূতিশীল করেছে।
ভাষণটির গঠনে কৌশলময়তা আছে, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ইতিহাস থেকে নেওয়া শিক্ষা, সময়জ্ঞান ও শব্দচয়নের মুনশিয়ানা আছে। বাঙালিকে ‘আমার দেশের গরিব-দুঃখী-নিরস্ত্র মানুষ’, ‘আমার মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছেন। পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য আজীবন আপসহীন সংগ্রাম, জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে জনগণের একেবারে হৃদয়ের ভেতরে ঢুকে যাওয়া তাঁর মতো নেতার পক্ষেই এই ভাষায় শ্রোতাদের সম্বোধন করা সম্ভব।
মানুষকে জাগ্রত, উদীপ্ত এবং তীব্র অধিকার সচেতন ও লড়াকু মানসিকতাসম্পন্ন করার জন্য সুদক্ষ বাগ্মীরা কতগুলো কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। বঙ্গবন্ধুও তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তা করেছেন পরিচ্ছন্ন দক্ষতা ও সুগভীর আন্তরিকতায়। মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজউইকের’ ভাষায় রাজনীতির এই ‘কবি’ আন্তরিক আবেগ-প্রয়োজনীয় তথ্য এবং বাংলার মানুষের ওপর নানা অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণের নির্মমতা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হাতিয়ারপ্রতিম ‘কি ওয়ার্ড’গুলো বারবার ব্যবহার করে নতুন ব্যঞ্জনা এবং মানুষের রক্তে বিদ্রোহের গতিবেগ সৃষ্টি করেছেন। এসব মূল কথা বারংবার সামনে আনায় শ্রোতাদের মনে তা স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে মুক্তি- ও ‘মুক্ত’ শব্দ দুটি বেশি গুরুত্বে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষ দুস্থ ও দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায়। তাই তিনি তাঁর ভাষণের চতুর্থ লাইনেই বলেছেন : ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’ এবং অষ্টম লাইনেই আবার ‘মুক্তি’ শব্দটি এসেছে এভাবে—‘এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ আবার বলেছেন : ‘যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে,’ এবং ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লা।’ তবে এই ঐতিহাসিক ভাষণের সারকথা যে বাক্যটিতে উচ্চারিত হয়েছে মুক্তির কথা তাতে সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। যেমন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বাংলার মানুষকে একাত্ম করার জন্য এবং নিজ ক্যারিসমা অনুযায়ী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে নিজ কাঁধে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘আমার’ শব্দটি বারংবার ব্যবহার করেছেন।
উদাহরণ ‘ভাইয়েরা আমার’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে’, ‘আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে’, ‘আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি… আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরিব, দুঃখী, নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে—তাঁর বুকের ওপর হচ্ছে গুলি’, ‘আমার গরিবের ওপর’, ‘আমার বাংলার মানুষের’, ‘আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে’, ‘আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে,’ ‘আমার মানুষ কষ্ট না করে’, ‘আমার লোককে হত্যা করা হয়’ ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে এবং শুরুতে বলেছিলেন, ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।’ এবং ভাষণের শেষাংশে আসতে আসতে তার কমিউনিকেট করার আত্মীয়সুলভ ভঙ্গিতে তিনি এমন স্তরে পৌঁছে গেছেন যে তাদের সহজেই ‘তুমি’ সম্বোধন করতে পারছেন। এতে শ্রোতার সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে এবং তাঁর বক্তব্যের আবেদন বেড়েছে। এতে বক্তা এবং শ্রোতা একাত্ম হয়েছেন। ভাষণের কেন্দ্রবিন্দুটি ঠিক রেখে তিনি নানা অপরিহার্য উপাদানকে গ্রথিত করেছেন। তবে ভাষণের ধারাবাহিকতাকে কখনো ক্ষুণ্ন হতে দেননি। এবং কোনো পয়েন্টই মূল বক্তব্যকে শিথিল করেনি। বরং ওই সব আনুষঙ্গিক উপাদান মূল বক্তব্যকে সংহত ও জোরালো করেছে।
বাংলাদেশের মানুষের একটা স্বকীয় সত্তা ও নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। লৌকিক ভাষাভঙ্গি ও বাক্ প্রতিষ্ঠায় তাঁর চমৎকার ও লাগসই প্রকাশ ঘটে। এই বিশিষ্ট সত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চারিত্রিক দার্ঢ্য বিদ্রোহের মানসিকতা এবং কোনো অবস্থায়ই মাথা নত না করা। বাংলার পৌরাণিক চরিত্র চাঁদ সওদাগর, সাহিত্যের চরিত্র হানিফ গাজী ও তোরাপ, কাব্যস্রষ্টা কবি নজরুল এবং মানবিক ও রাজনৈতিক চরিত্র শেখ মুজিবে আমরা এই বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাই। বাঙালি চরিত্রের এই বিশিষ্ট রূপের স্পর্শ পেয়ে ৭ই মার্চের ভাষণে যুক্ত হয়েছে অনন্য বৈভব। বঙ্গবন্ধু তাঁর আপসহীনতা ও চারিত্রিক দার্ঢ্যের পরিচয় মুদ্রিত করেছেন লৌকিক ভাবভঙ্গির বিশিষ্ট বুলির সংযোজনে। প্রাকৃতজনের ব্যবহৃত এসব মণিমুক্তাসদৃশ কিছু শব্দ বাঙালির ব্যাবহারিক জীবন থেকে নেওয়া। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শিকড়সম্পৃক্ত বুলিসমৃদ্ধ এ রকম একটি লাইন হলো—‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধু এই ভাষণকে কখনো কখনো শ্রোতাদের সঙ্গে প্রশ্ন করে করে সত্য যাচাইয়ের ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। যেমন—কী অন্যায় করেছিলাম? কী পেলাম আমরা? এসব প্রশ্ন যেন বঞ্চনার অমোঘ উদাহরণকে তুলে ধরেছে। এই ভাষণে যুক্তি ও মানবিক আবেগের নিপুণ সমন্বয় আছে। তেমনি রাজনীতির কবির ওজঃগুণসম্পন্ন, স্পন্দনযুক্ত চমৎকার রেটরিকস (Rhetorics) আছে। যুক্তির ক্ষেত্রে সর্বত্র গুরুত্ব দেওয়া একটি বাক্য ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ ইতিহাস আবেগ ও রেটরিক্যাল ভঙ্গির আর একটি উদাহরণ—‘আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’
জনগণের প্রবল চাপ ও প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাষণে বললেন, ‘অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারব না।’
বঙ্গবন্ধুর এই চারটি শর্তকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিচক্ষণ রণকৌশল হিসেবে আখ্যাত করা যায়। আমাদের বিবেচনায় মাস্টার-স্ট্রোক সমৃদ্ধ এই চারটি শর্তে তিনটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে : এক. স্বাধীনতা ঘোষণা শোনার জন্য পাগলপারা উত্তাল জনসমুদ্র একটু থমকে গেছে, তবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি, তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে যে বঙ্গবন্ধু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই একটি কৌশলগত ধাপ হিসেবে এই কঠিন চারটি শর্তকে সামনে নিয়ে এসেছেন; দুই. দৃশ্যত নেতা গণতন্ত্রসম্মত ও নিয়মতান্ত্রিক পথেই আছেন এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর এই শর্তসমূহ যৌক্তিক—বহির্বিশ্বকে এমন ধারণা দেওয়া। এই শর্ত দেওয়া না হলে, তাঁর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—এই বাক্যকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা বলে গণ্য করা হতো। তাতে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হতেন। ফলে আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বজনমত দুই-ই তাঁর বিপক্ষে চলে যেত। তাই রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও মেধাবী কৌশলবিদ হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েও তার কার্যকারিতাকে তিনি শর্তসাপেক্ষ করে রাখলেন। তিন. আমাদের ধারণা, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি শাসকচক্র ট্যাংক, মেশিনগান ও বিমান আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। এতে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতাই নিহত হতেন। স্বাধীনতার ঘোষণার শর্তযুক্ত বাতাবরণ পাক-শাসকদের সেই পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর ক্ষুরধার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা ক্রোধান্ধ বুনো শুয়োরের মতো নিজেরাই একতরফা ক্র্যাকডাউনে গিয়ে গণহত্যা শুরু করায় বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত বাতিল হয়ে গিয়ে ২৬ মার্চ থেকে তাঁর ঘোষণা কার্যকর হয়। ২৬ মার্চ মধ্য রাতে তাঁর স্বাধীনতার নতুন ঘোষণাটি ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
আসলে চারটি শর্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর ৭ই মার্চের আক্রমণকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা ওই দিন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তা না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ করার জন্য ইয়াহিয়া, ভুট্টো আলোচনার ছলনাময় অধ্যায়টির সূত্রপাত করে। ফলে পরিস্থিতি কী হবে তা কি বঙ্গবন্ধু জানতেন না? অবশ্যই জানতেন এবং তাঁরও কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি আলোচনা চালালেন কিন্তু জানতেন এ হবে নিষ্ফলা। সে জন্যই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হয়েও ৭ই মার্চের ভাষণে আসন্ন পরিস্থিতিতে বাঙালির করণীয় নির্ধারণ ও দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন এই ভাষায়—‘তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছুই—আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ পাকিস্তানি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই বক্তব্য গেরিলাযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ। দিব্য চোখে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েই যেন আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।’ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাটাকে আবার সামনে আনলেন—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
লেখক : চেয়ারম্যান, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
Leave a Reply