1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

নতুন বাজেটের নতুনত্ব

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১১ মে, ২০২২

মহামারী শেষ হয়েও শেষ হয়নি এমন একটি বছরের বাজেট, মতিগতিতে গজেন্দ্রগামী করোনাকালের বাজেট, বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতেও আপাতত তাল সামলানো অর্থনীতির বাজেট, যে অর্থনীতিতে বাজেট প্রকৃত অর্থে বাজেট হয় বা হবে কিনা এ ধরনের সংশয় সহস্র সম্পূরক প্রশ্নের পরিস্থিতি বিদ্যমান, সংবিধানের আওতায় প্রণীত ’অর্থবিল’-এর সঙ্গে সংসদে উপস্থাপিত, মিডিয়ায় বহুল উচ্চারিত, আলোচিত ও কণ্ঠভোটে পাস করা ‘বাজেটের’ মিল ও অমিল খুঁজে ফেরার, উচ্চাভিলাষ বনাম বাস্তবায়নযোগ্য বাজেটের কূলকিনারাহীন বিতর্কের, অবয়ব-অবকাঠামোর, অর্জনযোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন রেভিনিউ লক্ষ্যমাত্রার বাজেট আসবে আর মাত্র এক মাসের মাথায়। সেই বাজেট নিয়ে গতানুগতিক উৎসাহ-উদ্দীপনায়, সেই বাজেটে নতুন সংস্কার নতুন ভাবনার নতুন দর্শনের সম্মিলন অনুশীলন হবে কিনা এ ধরনের প্রত্যাশা প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে সবাই।

দুই বছর ধরে বাংলাদেশ বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করে চলেছে। এমনিতেই স্বাভাবিক অবস্থাতেও আমাদের দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নানান চ্যালেঞ্জ তো ছিলই। উপরন্তু আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে তাতে করোনার প্রভাবে বড় ব্যয় ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আরও সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। আমরা এখনো করোনার অর্থনীতিতেই আছি। বিগত দুটি বছরের অর্থনৈতিক সেক্টরে অচলাবস্থা, অনুৎপাদনশীলতা এবং দূরের ও কাছের দেশ নিচয়ে অস্থিতিশীলতার যে পরিস্থিতি তা গোটা অর্থনীতিকে ভাবাবে এবং সরাসরি রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ওপর প্রভাব ফেলবে। মানুষের যদি আয় কম হয় তা হলে তারা বেশি পরিমাণে ক্রয়-বিক্রয়ে যেতে পারবে না। যতই আমরা স্বাভাবিক হচ্ছি বা হওয়ার চেষ্টা পাচ্ছি, এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, করোনার কারণে বেশিরভাগ মানুষের স্বাভাবিক আয়-রোজগার কমে গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- সংকুচিত হয়ে গেছে। আমদানি-রপ্তানি আয়-ব্যয় কমে গেছে। আমদানি-রপ্তানি আয়-ব্যয় কমে যাওয়ার অর্থই হলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও সরবরাহ কমে যাওয়া। আয় বৈষম্যের ব্যাপক বিবর্তনে একশ্রেণির মানুষের আয়-ব্যয়ের দৌরাত্ম্য যতই দৃশ্যগোচর হোক না কেন, আমজনতা আগের মতো ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছে না, পারবে না। বাজারব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে না চললে অচল অর্থনীতি সচল হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। নতুন বাজেটে সে ব্যাপারে নীতি-নির্দেশনা ও করণীয় থাকবে।

করোনার কারণে বিগত দুটি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কমে গিয়েছিল, এখন একটু একটু করে আমদানি শুল্ক সূত্রে বাড়ছে যদিও, প্রত্যক্ষ কর ও মূসকে ধীরগতি ও মাত্রা কমে যাচ্ছে, যাবে। আগামী অর্থবছরেও এর প্রভাব অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের যেসব খাত, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এখনো ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে আছে তাদের যদি ট্যাক্স নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তা হলে এই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হতে পারে। করপোরেট ও ব্যক্তি পর্যায়ে এখনো অনেকেই কর প্রদান করেন না, যারা দেন বা যাদের কাছ থেকে আহরণ করা হয় তাদের কাছ থেকেও ন্যায্য পরিমাণে পাওয়া যায় না। দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ কর প্রদান ছাড়াই বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে এখনো বিরাট একটি বৈষম্য বিরাজ করছে, বাড়ছে। নতুন বাজেটে সমাজে বিদ্যমান আয় বৈষম্য কীভাবে দূর করা যায় সেদিকে দৃষ্টিদানের বিকল্প নেই। যাদের ওপর কর প্রযোজ্য তাদের কাছ থেকে তা সঠিকভাবে আদায় করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিদ্যমান বৈষম্য কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে গতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।

আমার নিশ্চিতভাবেই জানি যে, আমাদের অর্থনীতিতে ঘরে এবং বাইরে, দেশে এবং বিদেশে প্রচুর কালো টাকার উপস্থিতি রয়েছে। কালো টাকা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টির হেতুতে পরিণত হয়েই চলেছে। যে কারণেই ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও অত্যন্ত কম। প্রতিবেশী দেশগুলো এ ক্ষেত্রে আমাদের তুলনায় নাকি অনেক এগিয়ে আছে। সেদিন সাতসমুদ্দুর তের নদীর ওপারের একটি নামসর্বস্ব সংস্থা বলেছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছে। এ ধরনের স্বস্তি প্রদায়ক প্রতিবেদন এমন এক সময়ে প্রচার পাচ্ছে যখন যার যার হাঁড়ির খবর তার তার কাছে অজানা নয়। কালো টাকা অর্থনীতিতে ফেরত আনার জন্য জরিমানা ও জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া ট্যাক্সের হার কমিয়ে আনার যৌক্তিকতাকে, অর্থনীতিতে বিদ্যমান রেজিলিয়েন্ট পাওয়ারে চিড় ধরানোর পথ-পন্থা হিসেবে এটাকে দেখায় এর বিরূপ প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখা দেবেই।

কালো টাকার মালিকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের, যেভাবে হোক তার আয়ের উৎস জানার নৈতিক ও আইনগত যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা থাকবেই। যারা বৈধভাবে কর প্রদান করে তাদের কর হার দুর্নীতি জাত কালো টাকার মালিকদের কর হারের চেয়ে কম হওয়াটা হবে করন্যায্যতার নীতি-দর্শনের পরিপন্থী, আত্মঘাতী। হ্রাসকৃত হারে, জরিমানা ছাড়া ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার পেছনে যুক্তি দেখানো হয়, এতে কালো টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে চলে আসবে। কালো টাকা এমনিতেই এই অর্থনীতিতে অর্থনীতিতে অবৈধভাবে অর্জিত হয়েছে। কালো টাকা কেউ কেউ বাইরে পাচার করছে। কালো টাকার কথা তারা স্বীকার করতে পারছে না আইন জটিলতার কারণে। কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ঘোষণার ফলে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা হবে। প্রথমত, ন্যায্য করপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া। দ্বিতীয়ত, এতে বৈধ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা, তৃতীয়ত, দুর্নীতি জাত আয়ের পথ পন্থাকে প্রকারান্তরে পুনর্বাসিত করা। এরূপ এমনেস্টি প্রদানে কালো টাকা অর্জন উৎসাহিত হতে পারে। সমাজ ও অর্থনীতিতে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে কালো টাকা অর্জনে কিছু হবে না। রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে না। বরং তাদের এক এক সময় কম ট্যাক্সের বিনিময়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে। এতে অনৈতিকতার চর্চা উৎসাহিত হতে পারে। কালো টাকার মালিকদের তুলনামূলক কম ট্যাক্সের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি তার উপার্জিত অর্থের ওপর নির্ধারিত হারে কর প্রদান করছেন এবং যিনি কর প্রদান করছেন না তারা উভয়ে যদি একই অর্থনীতিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করেন তা হলে যিনি কর প্রদান করছেন তিনি বৈষম্যের শিকার হবেন। তিনি বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। কারণ যিনি বৈধভাবে কর প্রদানের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করছেন তার খরচ বেশি পড়বে। আর যিনি কর না দিয়েই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তার উৎপাদন ব্যয় কম হবে। কাজেই যিনি কর পরিশোধ করছেন না তার সঙ্গে নিয়মিত কর পরিশোধকারী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। তারা নিরুৎসাহিত হবে। ভবিষ্যতে কর আদায় কমে যাবে। করদান যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের নেটওয়ার্কের আওতায় আনার যে প্রচেষ্টা তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। করোনাকালীন সময়ে যেহেতু দেশের অর্থনীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রই সচল নেই এই সময় কালো টাকার মালিকদের কাছ থেকে যৌক্তিক হারে কর আদায়ের ওপর জোর দিতে পারলে অচল অর্থনীতি সচল করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হতে পারত। কাজেই আগামী অর্থবছরের বাজেটে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সার্ক দেশগুলোর তুলনায় অবশ্যই অনেক কম। আমাদের দেশের অর্থনীতি এবং আশপাশের দেশগুলোর অর্থনীতির বড় চরিত্রগত পার্থক্য হচ্ছে, সরকার অনেক আগে থেকেই ব্যবসায় বান্ধব হওয়ার নামে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কর প্রদানের ক্ষেত্রে বড় বড় ছাড় দিয়েছে। যেমন কৃষি খাতের জন্য কর ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কৃষি খাত শুধু দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করছে না। কৃষি এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষি খাতের অনেক উপখাত এখন প্রচুর অর্থ আয় করছে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কৃষির আওতায় এখন মাছ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই যুক্ত হয়েছে। কৃষিতে যারা বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারাও কৃষির নামে ট্যাক্স মওকুফ সুবিধা নিচ্ছে। প্রান্তিক চাষিকে আমি করের আওতায় আনব না এটা ঠিক আছে। কিন্তু যারা কৃষি খাতে বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের কেন করের আওতায় আনা হবে না? কৃষিকে অবলম্বন করে যারা বিত্তবান হচ্ছেন তাদের নিশ্চিতভাবেই করের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। এটা আমাদের দেশের একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা যে কৃষিতে পুরোটাই কর রেয়াত দেওয়া আছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে সব খাতে প্রতিযোগিতা ঠিক রাখার জন্য নির্ধারিত হারে কর ধার্যের বিধান আছে। আমাদের দেশে বড় বড় ব্যবসায়, বড় বড় অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের জন্য কর রেয়াত দেওয়া আছে। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে কর রেয়াত দেওয়া আছে। কর শুধু রাজস্ব উপার্জনের হাতিয়ার নয়। কর একই সঙ্গে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একটি উপায়ও বটে। কেউ যদি কর প্রদান করেন তাকে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে তা দিতে হয়। এজন্য প্রয়োজনীয় হিসাবপাতি করতে হয়, রাখতে হয়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। করের হিসাব করতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির কত টাকা আয়, কত টাকা ব্যয়, টাকা কোত্থেকে এলো এসব বিষয় উল্লেখ করতে হয়। ফলে কোম্পানিতে একটি আর্থিক হিসাবায়ন শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। আমাদের দেশে বড় বড় প্রকল্প এবং অনেক খাতই কর রেয়াতের আওতায় রয়েছে। নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থানে থেকেই অনেকে তাদের সুবিধা মতো কর রেয়াত, আর্থিক তথা ব্যাংক খাত থেকে বড় বড় ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নিচ্ছেন। আমজনতা মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার যুক্তিতে প্রযোজ্য কর রেয়াত, ব্যাংকের সুযোগ ও সেবা পাওয়ার বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ ব্যাপারে নতুন বাজেটে নীতি-নির্দেশনা নির্মাণের লক্ষ্যে পরীক্ষা পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন।

আগামী বাজেটে আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর জবাবদিহিকরণ নিশ্চিত করার প্রত্যাশা থাকবে। কেননা বাজেটে বরাদ্দ রাখলেই স্বাস্থ্য খাতে সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি, শিক্ষা খাতের বরাদ্দ শিক্ষকদের বসে বসে বেতন এবং বিনামূল্যে ধনী, দরিদ্র, নির্র্বিশেষে সবাইকে বই সরবরাহের পেছনে গেছে বা যাবে- মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না করতে পারলে জনসম্পদ উন্নয়ন হবে না। জনসম্পদ উন্নয়ন ব্যতিরেকে অচল অর্থনীতিকে সচল-সবল করা যাবে না, উন্নয়ন টেকসই হবে না।

 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com