একটি স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। অল্প সম্পদের সুষমবণ্টন, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা, আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে স্বাধীন বিচার বিভাগের নিশ্চয়তা ইত্যাদি নানাবিধ মৌলিক চাহিদা পূরণের স্বপ্ন নিয়েই মানুষের মনে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পরাজিত পাকিস্তানের ৫ ডিভিশন সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির আত্মসমর্পণের পরপরই, বিজয় আনন্দের স্বাদ উপভোগ করার আগেই সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষকে এক নতুন বাহিনীর তাণ্ডবলীলার ভয়ঙ্কর চিত্র দেখতে হয়েছিল। ‘১৬ ডিসেম্বর রাত থেকে বিজয়োল্লাসে মত্ত যেসব কথিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ১৭ ডিসেম্বর দেখা যায় তাদের হাতেই চীনা এ কে-৪৭ রাইফেল ও স্টেনগান। এসব অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার কোনো কথা ছিল না। বস্তুত এসব অস্ত্রধারী অধিকাংশ ক্ষেত্রে কখনো মুক্তিযোদ্ধাও ছিল না-অন্তত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ইউনিট নেতাই এদের শনাক্ত করতে পারেননি। জানা যায়, এতদিন যেসব তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সচ্ছল বা প্রভাবশালী অভিভাবকদের নিরাপদ আশ্রয়ে-বসবাস করছিল তারাও পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বিজয়োল্লাসে বিজয়ী পক্ষে যোগ দেয়। মুখ্যত এদের হাতেই ছিল পাকিস্তানি সৈন্য এবং সমর্থকদের ফেলে দেয়া অস্ত্র অথবা অরক্ষিত পাকিস্তানি অস্ত্রাগার থেকে লুট করা অস্ত্রশস্ত্র এবং অঢেল গোলাগুলি। ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর এই বাহিনীর উৎপত্তি ঘটে বলেই অচিরেই ঢাকাবাসীর কাছে এরা ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কালক্ষেপণ না করে এদেরই একটি অংশ অন্যের গাড়ি, বাড়ি, দোকানপাট, স্থাবর ও অস্থাবর বিষয়সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নামেমাত্র মূল্যে দখল করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। অহরহ হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের কাজে নিয়োজিত এই সিক্সটিন্থ বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষগুলোর মনে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগের পরিবর্তে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল (মঈদুল হাসান-মূলধারা :’৭১, পৃষ্ঠা-১৯৬-১৯৭)।
আমরা কি আজো মুক্তি পেয়েছি সেই সিক্সটিন্থ ডিভিশনের তাণ্ডবলীলা থেকে? আজ নতুনরূপে নতুন আঙ্গিকে তাদেরই দোসররা এই দেশের মানুষকে শোষণ, নির্যাতন করে চলেছে। আজও নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, লুণ্ঠিত হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ। অহরহ গুম, খুনের শিকার হচ্ছে প্রতিবাদী কণ্ঠ। নিরাপত্তাহীন এক ভয়ের রাজ্যে পরিণত হয়েছে স্বপ্নের স্বাধীন ভূ-খণ্ড।
নিশ্চয়তার জায়গাটুকু ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই হচ্ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। অনুতপ্ত হবার মতো অনুভূতিও আজ মানুষের বিবেকের সীমানায় নেই। কেমন যেন সব দানবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’ই মনে হচ্ছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। কারণ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই রাষ্ট্র একজন নিরপরাধ ছাত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একে-৪৭ এর গুলির আঘাতে জীবন দিতে হচ্ছে পথে। বিচার চাওয়ার জায়গাটুকুও নেই। কারণ দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। একজন পিতা রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাইতে এখন ভয় পাচ্ছেন। কেন এই ভীতিকর অবস্থা রাষ্ট্রের কাছে জবাব চাওয়ার মতো পরিবেশও নেই।
সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্রী প্রীতি। এ ঘটনার পর প্রীতির পিতা-মাতা বলেছেন,‘বিচার চাই না। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলাম। কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব?’ মেয়ে হত্যার পর এভাবেই ক্ষোভ, প্রতিবাদ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন সামিয়া আফরিন প্রীতির বাবা। রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার প্রতি কতটা আস্থাহীন হলে সন্ত্রাসীর হাতে নিহত হওয়ার পরেও রাষ্ট্রের কাছে পিতা তার সন্তান হত্যার বিচার চান না।
অপরাধী-নিরপরাধ যেই হোক কাউকে হত্যা করার অনুমোদন রাষ্ট্র দিতে পারে না। বিচারের দুবর্লতার কারণে কিংবা রাজনৈতিক শক্ত অবস্থানগত কারণে বা অর্থ-বিত্তের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধররা বিক্রি হয়ে যাওয়ার কারণে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে জাতির ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করছে।
সিক্সটিন্থ ডিভিশনের লোকেরা মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে যেমন রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছে তেমনি তারাই আবার সমাজের মাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই অবস্থা এখনো বিরাজমান। দেশের ১৮ কোটি মানুষের উৎপাদিত সম্পদ কতিপয় ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। ব্যবসা-বাণিজ্য তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদেরই সিন্ডিকেটের ফল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের এখন ত্রাহি অবস্থা। এখন মন্ত্রীরাও বলেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেন। প্রশ্ন হলো, যদি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে থাকে, তাহলে সরকার কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? ব্যবস্থা কে কার বিরুদ্ধে নেবে, তা নিরূপণ করার আগে আমাদের চিহ্নিত করা উচিত বর্তমান সংসদের মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে কতজন ব্যবসায়ী আছেন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী।
এর মধ্যে মহাজোট থেকে নির্বাচিত পেশায় ব্যবসায়ী আছেন ১৭৪ জন (৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ) এবং ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত, আছেন পাঁচজন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া তিনজন পেশায় ব্যবসায়ী (প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারি, ২০১৯)। বাকি ৩৯ শতাংশ সংসদ সদস্যের মধ্যে আইনজীবী ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক মাত্র পাঁচ শতাংশ ও অন্যান্য (শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিণী, পরামর্শক ইত্যাদি) পেশার ২১ শতাংশ সদস্য রয়েছেন (জাগো নিউজ ২৪.কম, ৩০ সেপ্টেম্বর,২০২০)। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন তাদের হাতেই অস্ত্র।
রাজনৈতিক দলগুলোতে নীতিনির্ধারণের জায়গায় রাজনৈতিক নেতাদের পরিবর্তে ব্যবসায়িক শ্রেণীর আধিক্য থাকার কারণে তারাই দেশের ভাগ্যবিধাতা হন, তারা রাজনীতি এবং ব্যবসায়িক জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়েন। আর তাদের এই অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে দলগুলো জনসম্পৃক্ততা হারিয়ে ফেলছে যার কারণে জনগণের ওপর আস্থা রেখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দলীয় নেতৃত্বের নেই। ফলে গণশক্তি নয়, পেশিশক্তি হয়ে যায় তাদের প্রধান অবলম্বন।
রাষ্ট্রের এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সুশাসন। সরকারে যারা থাকেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় দায় তাদের। জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানের প্রধান দায়িত্বও তাদের। নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যদি ঘা হয়ে যায়, তবে যে মলমই লাগান না কেন তা সারবে বলে মনে হয় না। তিলে তিলে ঘাগুলো গ্যাংগ্রিনে রূপ নিয়েছে। এখন পা কাটা ছাড়া উপায় কী ? কারণ সুশাসন যারা নিশ্চিত করবেন তারাই প্রধান অপরাধী।
যেহেতু ব্যবসায়ীদের বিরাট অংশ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তাই তারাই নির্ধারণ করে রাষ্ট্র কিভাবে চলবে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে অগণতন্ত্রই তাদের পছন্দ। এহেন অপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে শাসকশ্রেণী তাদের কাণ্ড-অপকাণ্ডের সমালোচনা শুনতে পছন্দ করে না অথবা ভয় পায়। তাই তাদের যত রাগ, যারা কথা বলে তাদের ওপর। যখনই কেউ কথা বলে তখনই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের স্টিম রোলার তাদের ওপর চালানো হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’ সদস্যরাও একই আচরণ করত।
তাদের হাত এতটাই শক্তিশালী, তারা সর্বোচ্চ আদালতের আদেশকেও মানতে চায় না। এই দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশের মাটিতে সেকেন্ড হোম, বেগমপাড়া যারা বানিয়েছে হাইকোর্ট বারবার তাদের তালিকা চাইলেও রাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা যারা কুক্ষিগত করে রেখেছে তাদের হাতেই সব নিয়ন্ত্রিত হয়।
আসল ব্যাপার হচ্ছে, মূল্যবোধের জায়গা থেকে আমরা রাষ্ট্র ও সমাজকে এখন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে নিতে পারিনি। সবকিছুই ব্যক্তি স্বার্থের দ্বন্দ্বে আবদ্ধ রেখেছি। অথচ একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রথম শর্ত হলো, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের দায়বদ্ধতা। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি হয়। কিন্তু জন্মের পরপরই সিক্সটিন্থ বাহিনী ব্যক্তিস্বার্থের জন্য সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার থেকে মুক্ত তো হইনি বরং দিনে দিনে এর আয়তন অনেক বড় হয়ে গেছে যার কারণে মানুষ তার সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েও কোনো কথা বলতে পারছে না। সামগ্রিকভাবে নাগরিক সচেতনতা এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ব্যতীত সিক্সটিন্থ বাহিনী যে বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেছে তার মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে না।
harun_980@gmail.com
Leave a Reply