জীবনসংগ্রামের প্রতিটি ধাপে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। কিছু পরীক্ষার দিন-তারিখ ধার্য করা থাকে, কিছু পরীক্ষা আসে অতর্কিত। কিছু পরীক্ষার প্রশ্ন জানা থাকে, কিছু পরীক্ষার প্রশ্ন থাকে অজানা। কিছু প্রশ্ন সাধারণ, কিছু প্রশ্ন অসাধারণ। মানবজীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তিনটি। লিখেছেন কাসেম শরীফ
এক. তুমি কোত্থেকে এসেছ? তোমার উৎস কী? তোমার স্রষ্টা কে? তোমার পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে মূল রূপকার কে?
দুই. তোমার পরিণতি ও সমাপ্তি কী? তোমার চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায়? তুমি কোথায় চলে যাবে?
তিন. সূচনা ও সমাপ্তির মধ্যবর্তী সময়ে তুমি কিভাবে নিজের জীবন অতিবাহিত করবে? তোমার জীবনের গাইডলাইন কী?
এই তিনটি প্রশ্ন সব ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শের মানুষের জন্য প্রযোজ্য এবং সব ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষের কাছে এই তিনটি প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন জবাব আছে। পবিত্র কোরআনও এই তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। এবং এই তিনটি প্রশ্নের জবাব কোরআনের সুরা ফুরকানের ছয় নম্বর রুকুর মধ্যে (৬১ থেকে ৭৬ নম্বর আয়াতে) বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে ইরশাদ হয়েছে, ‘কত মহান তিনি, যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করেছেন রাশিচক্র এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র। তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি এবং দিসবকে পরস্পরের অনুগামীরূপে—তার জন্য, যে উপদেশ গ্রহণ করতে ও কৃতজ্ঞ হতে চায়।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬১-৬২)
অর্থাৎ মানুষসহ গোটা পৃথিবীর সূচনা করেছেন মহান আল্লাহ। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা ও রূপকার।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হলো, যারা মহান আল্লাহকে রব ও বিধানদাতা মেনে তাঁর আনুগত্য করবে, তাদের স্থায়ী নিবাস ও চূড়ান্ত গন্তব্য হলো সুখময় জান্নাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের প্রতিদান দেওয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষ। কেননা তারা ছিল ধৈর্যশীল। তাদের সেখানে অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসেবে তা কত উত্কৃষ্ট!’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭৫-৭৬)
আর যারা মহান আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নেবে না, যারা মহান আল্লাহকে বিধানদাতা হিসেবে বিশ্বাস করবে না তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হলো জাহান্নাম। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তা (জাহান্নাম) অস্থায়ী ও স্থায়ী আবাস হিসেবে নিকৃষ্ট।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৬)
তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে সুরা ফুরকানে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো—
১. জমিনে বিনম্রভাবে চলাফেরা করা : ইরশাদ হয়েছে, ‘রহমান (আল্লাহ)-এর (বিশেষ) বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে বিনম্রভাবে চলাফেরা করে…।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৩)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি পদক্ষেপ করো সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিশ্চয়ই কণ্ঠস্বরের মধ্যে গাধার স্বরই সবচেয়ে অপ্রীতিকর।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৯)
২. মূর্খদের কথা, কাজ ও আচরণে ব্যথিত না হওয়া : ইরশাদ হয়েছে, ‘…এবং অজ্ঞ ব্যক্তিরা যখন তাদের (অপমানমূলক) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে সালাম।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৩)
এই সালাম প্রচলিত সালাম নয়, এটি হলো বিচ্ছেদের সালাম। এটি হলো উপেক্ষার সালাম। অর্থাৎ জ্ঞানী ও সম্মানিত মানুষেরা কখনো কখনো মূর্খদের মূর্খতাসুলভ কর্মকাণ্ডের সম্মুখীন হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে বিতর্কে না জড়িয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে।
৩. রাত অতিবাহিত করার পদ্ধতি : যারা মহান আল্লাহর আনুগত্যে নিবেদিত এবং আল্লাহর বিশেষ বান্দা হিসেবে বিবেচিত, সেই মানুষগুলো পাপে গা ভাসিয়ে রাত পার করে না। পানশালায় রাত পার করে না। তারা রাত অতিবাহিত করে আল্লাহর দরগাহে সিজদাবনত হয়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রবের উদ্দেশে সিজদাবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান থেকে।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৪)
৪. জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ চাওয়া : আল্লাহর বিশেষ বান্দারা সেসব কাজ থেকে বিরত থাকে, যেগুলো জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। পাশাপাশি তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করে থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত করুন। নিশ্চয়ই জাহান্নামের আজাব নিশ্চিত বিনাশ।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৫)
৫. ব্যয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা : আল্লাহর বিশেষ বান্দারা হালাল উপায়ে রিজিক অন্বেষণ করে। আহরিত রিজিক থেকে নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য ব্যয় করে অতিরিক্ত অংশ থেকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এতিম, অনাথ ও অসহায় মানুষের জন্য ব্যয় করে। এবং অর্থনৈতিক ইবাদতে পিছিয়ে থাকে না। কিন্তু সেটাও তারা করে থাকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্য করে না। বরং তারা আছে উভয়ের মধ্যপন্থায়।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৭)
৬. শিরকমুক্ত ইবাদত করা : রহমান আল্লাহর বিশেষ বান্দারা শিরক থেকে বেঁচে থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো উপাস্যকে ডাকে না…।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৮)
৭. অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা যাবে না : অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা গর্হিত অপরাধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘…নরহত্যা কিংবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করল…।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩২)
৮. জিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত না হওয়া : আল্লাহর বিশেষ বান্দারা বৈধ উপায়ে বিবাহের মাধ্যমে জৈবিক চাহিদা পূরণ করে। তারা কিছুতেই জিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। এ বিষয়ে সুরা ফুরকানের ৬৮ নম্বর আয়াতের পাশাপাশি অন্য অনেক আয়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে এসেছে, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, কেননা তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩২)
সমাজবিজ্ঞানী জে ডি আনউইন তাঁর ‘সেক্স অ্যান্ড কালচার’ বইয়ে দাবি করেছেন, তিনি পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস, ছয়টি সভ্যতা ও ৮০টি গোত্রের ওপর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে নৈতিক স্খলনের কারণেই এসব গোত্র ও সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি আরো দাবি করেছেন, যৌন উন্মাদনা ও সামাজিক শক্তি সমান্তরালে চলতে পারে না।
৯. কোনো পাপকর্ম হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা পাপ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। কিন্তু কখনো কোনো পাপ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করে নেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা (আজাবপ্রাপ্ত) নয়, যারা তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। আল্লাহ তাদের পাপ পরিবর্তন করে দেবেন পুণ্যের মাধ্যমে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭০)
১০. কোরআনের প্রতি অন্ধের মতো আচরণ না করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কোরআনের সঙ্গে অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ করে না। অর্থাৎ কোরআনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে না। বরং তারা কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের জীবন অতিবাহিত করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা তাদের রবের আয়াত স্মরণ করিয়ে দিলে তার প্রতি অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ করে না।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭৩)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।
Leave a Reply