বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে হঠাৎ করে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। রমজানের শুরুতেই গ্যাস সংকটে চরম বিপাকে পড়েছে সব শ্রেণির মানুষ। প্রথম রোজা থেকে শুরু হওয়া এ সংকট আরও কয়েকদিন চলতে পারে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
সংস্থাটি বলছে, বিবিয়ানায় মার্কিন কোম্পানি শেভরনের ছয়টি গ্যাস ক‚পে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। এ কারণে প্রায় ৪৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে গত দুই দিন ধরে রাজধানী এবং আশপাশের জেলাগুলোয় আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকরা গ্যাসের সংকটে পড়েছেন। গ্যাস সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ ছিল। রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোয় সিএনজি স্টেশনে ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি। কেউ কেউ গ্যাস না পেয়ে তেল কিনে গাড়ি চালাচ্ছেন। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে।
গ্যাস সংকটের কারণে আবাসিক গ্রাহকরা রান্না করতে পারছেন না। শিল্প গ্রাহকদের উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষ করে রমজানের শুরুতেই গ্যাসের সংকট গ্রাহকদের চরম কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংকটও দেখা দিয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমেছে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর মুগদা থেকে কামাল হোসেন নামে পেট্রোবাংলার সাবেক এক কর্মকর্তা ফোনে বলেন, ‘দুই দিন ধরে এলাকায় গ্যাস নেই। রোজার মধ্যে অনেক কষ্ট হচ্ছে। রান্নাবান্না করা যাচ্ছে না। এলাকায় গ্যাস না থাকায় হোটেলেও খাবার পাওয়া যাচ্ছে না।’
শুধু মুগদা নয়, খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে রাজধানীর গ্রিন রোড, রামপুরা, বনশ্রী, মগবাজার, কাঁঠালবাগান, ওয়েস্ট ধানমন্ডি, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, কাফরুল, আদাবর, আজিমপুর, লালবাগ, ধামমন্ডি, সিদ্ধেশ্বরী, মিরপুর, ক্রিসেন্ট রোড, জিগাতলা, শ্যামলী, কল্যাণপুর, এলিফ্যান্ট রোড, মতিঝিল, সেগুনবাগিচা, নারিন্দা, মিরপুর ১, ২ ও ১০ নম্বর, যাত্রাবাড়ী, কদতলী ও শনির আখড়া এলাকায় গতকাল গ্যাসের সংকট ছিল।
রাজধানীর দনিয়া এলাকা থেকে সাথী আক্তার নামে এক গৃহিণী জানান তাদের এলাকায় প্রায় সারা বছরই নিভু নিভু গ্যাস থাকে। কিন্তু গত দুই দিন ধরে একদমই গ্যাস নেই।
তবে গত দুই দিন ধরে লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটের বিষয়ে প্রায় একই ধরনের বিবৃতি দিচ্ছে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে কিছু কিছু গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে কোনো কোনো এলাকায় সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ করে যাচ্ছেন। খুব দ্রত সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আশা করা যাচ্ছে। সাময়িক এই অসিুবিধার জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে।
এদিকে গ্যাস সংকটের বিষয়ে পেট্রোবাংলার উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য হ্রাসকৃত হারে গ্যাস সরবরাহের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস স্বল্পতার সৃষ্টি হতে পারে। রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ সম্পন্ন করে দ্রæততম সময়ের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সাময়িক এ অসুবিধার জন্য পেট্রোবাংলা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বিবিয়ানা অন্যতম। সেখানকার ছয়টি ক‚প থেকে হঠাৎ গ্যাস উত্তোলন বন্ধ দেয় শেভরন। এতে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগানের সংকট তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ সারাদেশে। বিবিয়ানার ছয়টি ক‚প থেকে গত শনিবার রাতে গ্যাস উত্তোলনের সময় বালি উঠতে শুরু করে। এ কারণে গ্যাস উত্তোলন কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। ওই রাতেই প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। যার প্রভাব পড়ে সরবরাহ ব্যবস্থায়।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান জানান, একটি ক‚প থেকে ইতোমধ্যে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। আজ (গতকাল) সন্ধ্যার মধ্যে আরও তিনটি ক‚প উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এতে সংকট কিছুটা কমে আসবে। তবে একেবারে কেটে যাবে না।
এদিকে শুধু আবাসিক গ্রাহক নয়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক আমাদের সময়কে বলেন, স্বাভাবিক সময়েই গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ নেই। প্রয়োজনের চেয়ে কম চাপে গ্যাসের সরবরাহ করা হয়। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে গ্যাস নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী আল-মামুন আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিবিয়ানার ছয়টি ক‚প হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্যাসের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। তবে ইতোমধ্যে একটি ক‚পে তারা আবারও উত্তোলন শুরু হয়েছে। আশা করছি দ্রæততম সময়ের মধ্যে বাকিগুলো থেকেও উত্তোলন শুরু করে সরবরাহ স্বাভাবিক করা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়। সব মিলিয়ে ২৭শ থেকে ২৮শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ করা হতো। কিন্তু সেটা এখন ২৩শ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে আসায় সংকট তীব্র হয়েছে। এ ছাড়া স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা একটি এলএনজির কার্গো ৪ তারিখে পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু সেটা দেরি করার কারণে ৭ তারিখে পৌঁছাবে। ফলে আগামী ৯ তারিখ থেকে এলএনজির সরবরাহ বাড়বে।’ ফলে তখন থেকে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে তিনি মনে করছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে তিন মাস ধরে পাইপলাইনের বিকল্প জ¦ালানি এলপিজির দাম বাড়ছে। গত রবিবার প্রতি কেজি এলপিজির দাম ১১৬ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১৯ টাকা ৯৪ পয়সা করা হয়েছে। এতে প্রতি ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৩৯১ টাকা থেকে ৪৮ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৩৯ টাকা করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ জায়গায় সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি পাওয়া যায় না। ডিলাররা নিজেদের মতো করে নির্ধারিত দামে বিক্রি করছে। এ ছাড়া গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিজেল ও কোরোসিনের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এ ছাড়া গত ২১ মার্চ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
জ¦ালানি খাতের পণ্যের সামগ্রিক এই ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। ফরিদ হোসেন নামে জনতা ব্যাংকের এক চাকরিজীবী আমাদের সময়কে বলেন, ‘জ¦ালানি খাতের পণ্যের দামের ওপর সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ও দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়, গ্যাসের দাম বাড়লে পরিবহন পণ্য মূল্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে দফায় দফায় এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর মানে হলো সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলে দেওয়া।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘বাংলাদেশের জ¦ালানি খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে আর্ন্তজাতিক বাজারে জ¦ালানি পণ্যের মূল্য বাড়লেই আমাদের দেশে প্রভাব পড়ে। আর জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়লে বাজার ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ে যায়। কিন্তু আমাদের এখানে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে মানুষের ওপর সব দায় পড়ে। মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়।’
Leave a Reply