ট্রেনের জন্য ৭০টি ইঞ্জিন কিনতে প্রকল্প হাতে নেয় রেল। ১১ বছর আগে ২০১১ সালে প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। ঠিকাদারের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় ও ইঞ্জিন কেনার উদ্যোগে আছে চড়া সুদ। এই কঠিন শর্তের কারণেই চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিলের নির্দেশনা আসে অর্থ বিভাগ থেকে। ইতোমধ্যে বসিয়ে বসিয়ে বেতন প্রদানসহ আনুষঙ্গিক কাজে এ পর্যন্ত সরকারের ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা গচ্চা গেছে।
বিষয়টি এমন, একটি অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় দীর্ঘ ১১ বছর কিছু ব্যক্তি তাদের বেতন-ভাতা, গাড়িসহ রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করছেন। একে অভিনব কায়দায় রাষ্ট্রের অপচয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। অপচয়ের এত বছর পর এখন বিকল্প ব্যবস্থায় প্রকল্প জিইয়ে রাখার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, সরবরাহকারীর মাধ্যমে ঋণ জোগাড় করে এই ইঞ্জিন কেনা হলে গুনতে হবে অন্তত ৪ শতাংশ হারে সুদ। মূলত ঋণ সরবরাহকারী ব্যাংক সুদ ছাড়াও মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম নিচ্ছে। এর পরিমাণ ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। তাই প্রায় চার কোটি ডলার অতিরিক্ত ঋণ নিতে হচ্ছে। যদিও এক দশক পরে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তা ছাড়া এর চেয়ে কম ব্যয়ে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে ইঞ্জিন কিনতে পেরেছে সরকার। সাত বছর পার হয়েছে কেবল ঠিকাদার ঠিক করতে। আর প্রকল্পের মোট সময় পার হয়েছে ১১ বছর।
সময়ক্ষেপণে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম ১৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় দাঁড়াচ্ছে বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১১ বছরে এসে সিদ্ধান্ত ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের। আবার নতুন করে ঋণের ধরন পরিবর্তন করতে হবে; হার্ড লোন থেকে সফট লোন। তাই সংশোধন করতে হবে ডিপিপি। নতুন করে দরপত্র আহ্বানও করতে হবে। সবশেষে যা কেনা হবে তার নাম মিটারগেজ ইঞ্জিন। অথচ দেশের অধিকাংশ রেলপথ মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।
২০১১ সালে রেল যখন প্রকল্প হাতে নেয়, তখন সরকারিভাবে অর্থায়নের উৎস জোগাড় করা যাচ্ছিল না। সময় পাল্টেছে। অর্থ জোগাড় করে একাধিক প্রকল্পে ট্রেনের ইঞ্জিন কেনা হয়। তদুপরি ৭০ ইঞ্জিন প্রকল্প জিইয়ে রাখা হয়। চড়া সুদে অত্যধিক ব্যয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চলে দেন-দরবার। কিছু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি ধরে রেখে রাষ্ট্রের সোয়া ৫ কোটি টাকা অপচয়ের বন্দোবস্ত করেন। প্রকল্পটি বাতিল না করে মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনায় এখনো আগ্রহ আছে তাদের। এতে সরকারি টাকা অপচয়ের পথ আরও প্রশস্ত হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্ন তো আছেই।
মোট ২ হাজার ৬৭৯ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার কথা কোরিয়ান কোম্পানির। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের ঋণ জোগাড় করার কথা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) ও জাপানের সুমিতোমো মিটসুই ব্যাংকিং করপোরেশন (এসএমবিসি) দাবি করে কঠিন শর্তের ঋণ। এ ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার ডলার, যা ইঞ্জিনের দামের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি।
এমন অবস্থায় সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘কোরিয়ান কোম্পানি কর্তৃক প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকার কর্তৃক এত উচ্চহার সুদে অনমনীয় ঋণগ্রহণের পরিবর্তে কোরিয়ান সরকারের নমনীয় উৎসের বা অন্য কোনো উৎসের নমনীয় প্রকৃতির ঋণ সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয় হবে।’
ইআরডির এমন মতামতের ভিত্তিতে হুন্দাই রোটেমকে গত ১৮ নভেম্বর চিঠি দেন প্রকল্প পরিচালক। এরপর গত ১ ও ১৩ ডিসেম্বর হুন্দাই রোটেম জানায়, নমনীয় উৎস বা অন্য কোনো উৎসের নমনীয় প্রকৃতির ঋণ দাখিলে তাদের আগ্রহ নেই। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল করে পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি (পিবিসি) ফেরত দিতে অনুরোধ করে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে গত বছরের ৩ আগস্ট ঠিকাদার বরং লেবার চার্জসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও পারফরম্যান্স সিকিউরিটির ব্যাংক চার্জ বাবদ খরচের কারণ দেখিয়ে চুক্তিমূল্য ১৬ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি করেছিল। তখন রেল জানায়, চুক্তি অনুযায়ী খরচ বৃদ্ধির সুযোগ নেই।
এরপর প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের জমার বিপরীতে প্রতি মাসে প্রায় ৩৩ হাজার ডলার ব্যাংক চার্জ দিতে হচ্ছে। তাই ঋণচুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই টাকা ফেরত দিতে আবার অনুরোধ করে।
তারা এ-ও বলেছিল, বাণিজ্যিক চুক্তিমূল্য না বাড়ালে প্রয়োজনে চুক্তি বাতিল করতে। এখন এ প্রকল্পের করণীয় জানতে সিপিটিইউ ও আইএমইডির মতামত চাওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা যাই হোক- জ্বালানি খরচ, বেতন, আউট সোর্সিংসহ নানা খাতের ভুল অর্থনৈতিক কোড সংশোধনের প্রস্তাব আসে এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের এক সভায়।
প্রকল্প পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের ওই সভায় বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে আরডিপিপির ৯টি অনুমোদিত অঙ্গের অর্থনৈতিক কোড সংশোধন করতে হবে। এ প্রকল্প ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে চলছে। এডিপি বরাদ্দ থেকে শুধু জনবলের বেতন-ভাতা, গাড়ির জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ, সভার সম্মানী ও ভ্রমণ ব্যয় বহন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত খরচের পরিমাণ ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা।’
জানা গেছে, ৭০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কিনতে প্রথমবার ২০১১ সালে এবং ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। দুবারই নন-রেসপনসিভ হয় দরপত্র। পরবর্তী সময়ে স্পেসিফিকেশনের ৩টি শর্ত পরিবর্তন করে টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিংয়ের অর্থায়নে নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ডাকা দরপত্র অনুযায়ী ক্রয় প্রস্তাবটি সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। ২০১৮ সালের ১৬ মে ছিল অনুমোদনের তারিখ। সে অনুযায়ী হুন্দাই রোটেম নামের কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর চুক্তি করে রেলওয়ে। সমস্যা তৈরি হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে জোগাড় হতে যাওয়া ঋণের অর্থ নিয়ে। কঠিন সুদ দাবি করায় বিপত্তি বাধে। এর জেরেই ‘এত উচ্চসুদে’ উল্লেখ করে আপত্তি জানায় অর্থ বিভাগ। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রবিবার রেল ভবনে এডিবির সঙ্গে বৈঠক করে এ প্রকল্পে ঋণ দিতে অনুরোধ করা হয়। তবে এডিবির জবাব মেলেনি।
এর আগে ৩০ ডিসেম্বর প্রকল্প পরিচালক পৃথক চিঠিতে বলেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তি বাতিল করে নতুনভাবে দরপত্র আহ্বান করা যেতে পারে। তার আগে এডিবির ফান্ড সংগ্রহ করে ডিপিপি সংশোধন করে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
এখন কোরিয়ান ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে, নাকি পারফরম্যান্স গ্যারান্টির টাকা ফেরত দেওয়া হবে- এ নিয়ে মতামত চেয়েছে সিপিটিইউ ও আইএমইডির কাছে। কোরিয়ান ঠিকাদারের কাছ থেকে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাবদ ২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৬ ডলার মূল্যের ব্যাংক গ্যারান্টি বাংলাদেশ রেলওয়েতে জমা আছে। ক্রয় চুক্তিটি শর্ত অনুযায়ী কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে সরবরাহকারীর চুক্তিভুক্ত মালামাল সরবরাহের বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
এদিকে প্রকল্পে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা এ পর্যন্ত খরচ হয়ে যাওয়ায় সরবরাহ করতে না পারায় ঠিকাদারকে জরিমানা করা যায় কিনা তা জানতে চায় রেল মন্ত্রণালয়। তখন প্রকল্পকর্তারা বলেন, চুক্তি হয় ২০১৮ সালে আর প্রকল্প চলতে থাকে ২০১১ সাল থেকে। চুক্তি অকার্যকর থাকায় চুক্তির বিপরীতে খরচ হয়নি। খরচ হয়েছে বেতন-ভাতা, ট্রান্সপোর্টেশন ও দাপ্তরিক দৈনন্দিন কাজে। তাই এক্ষেত্রে ঠিকাদারের দায় নেই বলে নিশ্চিত করেন প্রকল্প পরিচালক।
Leave a Reply