সেদিনও ছিল ভালোবাসা দিবস, ফুল-ফাগুনের দ্বিতীয় দিন। আর সেদিনই গগনবিদারী স্লোগানে মুখর হাজারো শিক্ষার্থী নেমে এসেছিলেন রাজপথে। এই ছাত্রছাত্রীর অধিকাংশেরই স্মৃতিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। তাদের কেউ বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছিলেন মায়ের কোলে থেকে, কেউ বা আবার পুড়ে যাওয়া বসত পেছনে রেখে ছোট্ট পায়ে বাবার হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে দেখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। বাবা-ভাইয়ের সংগ্রামের স্মৃতি, সশস্ত্র প্রতিরোধের দোলা ছিল তাদের রক্তেও। স্বাধীনতার পর একের পর এক অন্যায়-অরাজকতা দেখতে দেখতে আর সহ্য করতে পারেননি তারা। তাই ১৯৮৩ সালের এই ১৪ ফেব্রæয়ারি বিদ্রোহে তারা ফুঁসে উঠেছিলেন ঢাকার রাজপথে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তারই দেখানো পথ ধরে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্র দখল করেছিলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতা দখলের পর সামরিক স্বৈরশাসকদের যেমন হয়, তেমনি নেমে পড়লেন ক্ষমতা সুসংহত করতে। প্রথম ধাপ হিসেবে হাত দিলেন শিক্ষাব্যবস্থায়। কারণ এই শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ক্রান্তিকালের কাÐারি, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভ‚মিকা রাখা ছাত্রসমাজকে। তার এই নীলনকশা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ল সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ওপর।
১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করলেন। নতুন শিক্ষানীতি দেখে সবাই তাজ্জব। এ যেন পাকিস্তানি জান্তা আইয়ুব খানের আমলে করা ‘আমলে শরিফ শিক্ষা কমিশন’-এর রিপোর্টই একটু বদলে প্রায় পুরোটাই কাট-কপি পেস্ট করে বসিয়ে ছাপানো। কী ছিল মজিদ খানের ওই শিক্ষানীতিতে? প্রথমেই ছিল প্রথম শ্রেণি থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। এসএসসি কোর্স হবে ১২ বছর। রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হবে শিক্ষার ৫০ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতাকে। খর্ব করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন।
নতুন এ অনৈতিক নীতি ঘোষণার পর থেকেই আন্দোলন শুরু করেন সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ ছিল- নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে আরবি ও ইংরেজি জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাকে ব্যয়বহুল, বৈষম্যমূলক এবং সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতির। এই দাবির পক্ষে আর প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ১১টি ছাত্র সংগঠন।
১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি। এদিন ছাত্রদের দাবি উপেক্ষা করে সারাদেশের ১৪২টি থানার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে আরবি শিক্ষা শুরুর আদেশ দেয় সরকার। মাতৃভাষা বাংলায় বুৎপত্তি অর্জনের আগে শিক্ষার্থীদের ওপর আরবি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার এই হীন চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্র ও শিক্ষকসমাজ। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা এ প্রতিবাদটিকে নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে সামরিক সরকার। এর পর আসে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি। এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী মিছিল করে শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দিতে যাচ্ছিলেন। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা।
শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআরের ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। শিক্ষার্থীরা তখন তোপখানা রোডে বসেই ¯েøাগান দিতে শুরু করেন। আর ঠিক তখনই বিন্দুমাত্র উসকানি ছাড়া শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয় হামলা চালায় পুলিশ আর বিডিআর। প্রথমে টিয়ার শেল আর জলকামানে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় তারা। এর পর শুরু করে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর সরাসরি গুলিবর্ষণ। গুলি শুরুর পর সেদিন তোপখানা রোডের পিচ রক্তে লাল হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের গুলিতে। রাজপথেই খুন হন দীপালি সাহা-জয়নালসহ অন্তত ১০ জন। প্রাণ বাঁচাতে শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নেন পাশের শিশু একাডেমি কমপ্লেক্সে। বর্বরতা থেকে রক্ষা পায়নি অনুষ্ঠানে আসা শিশুরাও।
সেদিনের আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে সারাদিনের প্রচÐ এবং অসম এই সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হন। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার নামে এত মৃতদেহের সবই গুম করে ফেলে এরশাদের বাহিনী। এত রক্ত ঝরিয়েও এরশাদ সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে পারেনি। রাজপথে খুনের প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রæয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহŸান করা হয়। আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও তীব্রতর। শেষে ১৭ ফেব্রæয়ারি প্রেস নোটে সরকার জানায়, জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার ১ হাজার ২২১ জনকে মুক্তি দেয় সরকার। অসংখ্য ছাত্র-জনতার লাশ সামনে রেখে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি পালিত হয়েছিল এক বেদনা-বিধুর শোকাবহে।
কালপ্রবাহে ওই গুম হয়ে যাওয়া ৫০ শহীদের লাশের মতো গুম হয়ে গেছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের স্মৃতিও। আমরাও ভুলে গিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের প্রতি দায়বদ্ধ, দেশের প্রতি ভালোবাসায় বুকে আগুন পুষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ওই শহীদ শিক্ষার্থীদের নাম।
১৪ ফেব্রæয়ারি এখন কেবলই ফাগুনের প্রথম দিন, ভালোবাসা দিবস। ১৯৮৩ সালের ওই ১৪ ফেব্রæয়ারিতে তো আর এখনকার এই ভালোবাসা দিবস পালনের জাঁকজমক ছিল না। আজ আমরা একটি মধ্যম আয়ের দেশে বাস করছি। বিদেশি ফুল, চকলেট, চকচকে র্যাপিংয়ে উদযাপন করি ভালোবাসা। এই সময়ে এসে যেন আমরা ভুলে না যাই- এমন অসংখ্য দীপালি সাহা, জয়নাল, কাঞ্চনদের রক্তনদী পেরিয়ে আমাদের এই অর্জন। ১৯৮৩ সালের সেই শিক্ষার্থীদের রক্তনদীই ছিল স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম বিস্ফোরণ। এর পর গোটা আশি ও নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগজুড়ে দিনটি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের ফলে নব্বইয়ের গণআন্দোলন হয়, স্বৈরাচারমুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ।
সন্দীপন বসু : গণমাধ্যমকর্মী
Leave a Reply