অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণ হলো ব্যাংক ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে তফশিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৫৫। এই ৫৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৯টি হলো বিদেশি। ৪৬টি দেশীয় ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি বেসরকারি ও ৬টি সরকারি ব্যাংক হিসাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
ব্যাংকগুলোয় মোট আমানতকারী গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৫ লাখ। তবে একই গ্রাহকের একাধিক ব্যাংকে কিংবা একই ব্যাংকে একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকায় প্রকৃত গ্রাহকের সংখ্যা আরও কম হবে। এই বিপুলসংখ্যক গ্রাহক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকগুলোয় যে পরিমাণ আমানত জমা করেছেন, তার পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ কোটি টাকা। এই আমানত থেকেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে থাকে। এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে কাজ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া হিসাবের সংখ্যা হলো ১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার টাকা।
তবে এখানেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক কম হবে। কারণ, একই গ্রাহক কিংবা প্রতিষ্ঠান একই নামে একাধিক হিসাব থেকে ঋণ নিয়েছে। বিভিন্ন জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশেরও কম মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছে। আর ঋণ পাওয়া জনগোষ্ঠীর হার ৫ শতাংশেরও কম। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণেই এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল খাত। এ খাতের যে কোনো ভালো-মন্দ আমাদের আশা-নিরাশার দোলায় দোলাতে চায়। আমাদের স্বস্তি ও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে। আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
করোনা অতিমারির কারণে ২০২০ সালের প্রায় পুরো সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হওয়া সত্ত্বেও সারা দেশের ব্যাংকগুলোয় আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের জুলাই-নভেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল ৮৬ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫৮ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সাল অনেকটাই কর্মমুখর ছিল। তা সত্ত্বেও আমানত বৃদ্ধির হার কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালের জুলাই-নভেম্বরে ব্যাংকগুলোয় আমানত বেড়েছে মাত্র ৪২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০২০ সালের তুলনায় আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ৫১ শতাংশ। ২০২০ সালে একই সময়ে মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৯ শতাংশ। কিন্তু ২০২১ সালে এসে তা কমেছে প্রায় ৪১ শতাংশ। এটি একটি পরস্পরবিরোধী চিত্র। যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির ছিল, তখন আমানত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে, আর যখন অর্থনীতি সচল হয়ে ওঠে, তখন তা কমে যায়-এটি মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া এর একটি কারণ হতে পারে।
দ্বিতীয় কারণটি উদ্বেগের। তাদের মতে, অর্থ পাচার বেড়ে যেতে পারে। এখন অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে ব্যবসা করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বড় ব্যবসায়ী তো বটেই, মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরাও এখন ক্ষেত্র হিসাবে দুবাইকে পছন্দ করছেন। সেখানে বিনিয়োগের জন্য টাকা পাচার হতে পারে। তাছাড়া সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও ব্যবসায়ীদের পছন্দের তালিকায় আছে। বড় ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি পণ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করছেন, আর মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলছে, সম্প্রতি দেশে খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) মার্কিন ডলারের দাম ৯২ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। অথচ ব্যাংকগুলোয় প্রতি ডলারের বিনিময় হার হলো ৮৬ টাকা। ব্যাংক খাতের সঙ্গে খুচরা বাজারে ডলারের দামের এই বড় ধরনের তারতম্যের সঙ্গে অর্থ পাচারের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আমানতের উচ্চ প্রবৃদ্ধি থমকে যাওয়া সম্পর্কে ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। সরকার বিলবন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়িয়েছে। ডলারের তীব্র চাহিদা মেটাতে অর্থবছরের প্রথমার্ধেই ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে বাজার থেকে সমপরিমাণ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুলেও নিয়েছে। এসব কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। আমানতের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য হলো, ২০২১ সালের নভেম্বরে ব্যাংক খাতে মেয়াদি ও তলবি আমানতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা ছিল মেয়াদি আমানত। আর তলবি আমানত ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ১০৪ কোটি টাকা।
২০২০ সালে আমানতের এই উল্লম্ফনের কারণে তারল্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো আমানতি সুদ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়। তারা আমানতের ওপর সুদহার কমাতে কমাতে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে ফেলে। তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৩ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে ফেলে। সরকার তখন আমানতকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত দেয় যে, আমানতি সুদের হার কোনোক্রমেই বার্ষিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম করা যাবে না। ধারণা করা হয়েছিল, তাতে ব্যাংক আমানত বাড়বে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অনেকে মনে করেন, করোনাকালে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কম হওয়ায় টাকা ব্যাংকে জমা ছিল। তাছাড়া ২০২০ সালে মানুষের পারিবারিক ব্যয়ও কমে গিয়েছিল, যা এখন অনেক মাত্রায় বেড়েছে। আমানত কমে যাওয়ার এটাও একটি কারণ। ব্যাংক খাতে সুদের হার কমে যাওয়ায় অনেকেই পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ব্যাংক থেকে মেয়াদি আমানত তুলে নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এর পক্ষে যুক্তি হলো, ২০২০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দৈনিক গড়ে লেনদেন যেখানে ছিল ৬৪৮ কোটি টাকা, সেখানে ২০২১ সালে গড়ে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় অস্বস্তির খবর হলো, দিনদিন প্রতিষ্ঠানগুলো বড় বড় গ্রাহকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে। বড় ধরনের ঋণের ঝুঁকিতে আছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক তার ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসিসমেন্ট রিপোর্টে বলছে, এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো শীর্ষ গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় করা। পরিস্থিতি এমন যে, শীর্ষ মাত্র তিন গ্রাহক যদি খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে ১৬টি ব্যাংক তার ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা হারাবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ তো বছর বছরই বাড়ছে। সেক্ষেত্রে যদি আর মাত্র ৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ বাড়ে, তাহলে চারটি ব্যাংকের মূলধন সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। আবার সর্বোচ্চ ঋণ স্থিতি থাকা খাতের খেলাপি ঋণ যদি ৩ শতাংশ বেড়ে যায়, তাহলে অন্তত তিনটি ব্যাংক তার ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা হারাবে। সুতরাং বড় বড় গ্রাহকের আচরণের ওপর পুরো ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
এই বড় যে কত বড়, তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। দেশে এমনও বড় ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেটি একাই ৩০-৩৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৬৬ শতাংশই মাত্র ১০০টি প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভূত। এই বড় বড় গ্রাহককে সামাল দিতেই ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা ব্যতিব্যস্ত। তাদের মতে, ‘ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কর্মঘণ্টার বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে শীর্ষ গ্রাহকদের ঋণ নিয়মিত রাখার স্বার্থে। ঋণ নিয়মিত দেখানোর জন্য নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করেই এ ধরনের গ্রাহকদের অবারিত সুযোগ দিচ্ছে ব্যাংক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু ঋণ দেওয়ার জন্যই ব্যাংকারদের সহযোগিতায় নিত্যনতুন কোম্পানি খোলা হচ্ছে। নতুন ঋণ দিয়ে পুরোনো ঋণের সুদ আদায় দেখানো হচ্ছে। পুনঃতফশিলসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বড় গ্রাহকদের ঋণের নথি পাঠাচ্ছে ব্যাংক। এসব ফাইল পর্যালোচনা ও অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।’
বড় বড় গ্রাহকের সুদ মওকুফ এখন ব্যাংক খাতের একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি একাধিক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক বড় কয়েকজন গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। একথা ঠিক যে, যেহেতু বড় গ্রাহকরা মুনাফার বড় অংশের জোগান দেয়, স্বাভাবিক কারণেই তাদের নিয়ে দৌড়ঝাঁপ বেশি। কিন্তু বিপরীতভাবে এটাও মনে রাখতে হবে, একজন বড় গ্রাহক ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক যতটা ঝুঁকিতে পড়ে, ছোট ১০০ গ্রাহক খেলাপি হলেও ঝুঁকির পরিমাণ তার চেয়ে কম থাকে।
বড় গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়াটা একটি জাতীয় সমস্যা বলে অনেকে মনে করেন। এর সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি আমরা।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ব^বিদ্যালয়
Leave a Reply