রাজধানী ঢাকায় গত বছরের তুলনায় বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদ। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে মোট বিবাহবিচ্ছেদ হয় ৯ হাজার ৭৮৭ জনের। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজার ৯১৯ জনের। ঢাকায় প্রতিদিন তালাকের ঘটনা ঘটছে ৩৩টি। অর্থাৎ প্রতি দুই ঘণ্টায় প্রায় তিনজনের বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালে, যা শতাংশের হিসাবে গত এক বছরে প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাকের নোটিশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানোর বিধান রয়েছে। প্রথমে মেয়রের কার্যালয়ে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত হয়। তারপর সেখান থেকে আবেদন মূলত স্ত্রী কোনো অঞ্চলে বসবাস করছেন, সেই অনুযায়ী ওই অঞ্চলের কার্যালয়ে (সিটি করপোরেশনের) পাঠানো হয়। দুই সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তালাকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনে স্বামীদের তুলনায় এগিয়ে স্ত্রীরা। গত এক বছরে স্ত্রীদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন ছিল ৭১ ভাগ। অন্যদিকে স্বামীরা বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেছেন ২৯ ভাগ।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বরাবরের মতোই আবেদনপত্রে কিছু কারণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্ত্রীর ওপর নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত। তবে পুরুষরা অন্য কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে পরকীয়া, আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
বেশ কয়েকজন সমাজবিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় করোনার এই কঠিন সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে রয়েছে কিছু অভিন্ন কারণ। এর মধ্যে তারা উল্লেখ করেন করোনার কারণে তৈরি হওয়া মানসিক, আর্থিকসহ নানামুখী চাপ। চাকরি হারিয়ে অনেকেরই পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে না পারা, ব্যবসায় লস, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন এবং যোগাযোগ কমে যাওয়া। মনস্তাত্ত্বিক এই চাপ দাম্পত্য কলহ ও সংকটকে প্রভাবিত করছে। পারিবারিক কলহের জেরে বেড়েছে বিচ্ছেদের ঘটনা।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট তালাকের আবেদন জমা পড়ে ৯ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩ হাজার ৪৪২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬ হাজার ৩৪৫ জন। তবে ওই বছরের এপ্রিল মাসে সারাদেশে লকডাউন চলায় তালাকের কোনো আবেদন জমা পড়েনি। অন্যদিকে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ১১ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪ হাজার ৬৭৪ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭ হাজার ২৪৫ জন। এক বছরে তালাকের পরিমাণ বেড়েছে ২ হাজার ১৩২ জন। শতাংশের হিসেবে যা বেড়েছে ২২ ভাগ।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীরা আবেদন করেছেন ৯ হাজার ২৬৪ জন। একই সময়ে স্বামীরা আবেদন করেছেন ৩ হাজার ৮২৪ জন। অর্থাৎ মোট বিবাহবিচ্ছেদের ৭১ ভাগ স্ত্রীরা আবেদন করেছেন। পক্ষান্তরে স্বামীরা আবেদন করেছেন ২৯ ভাগ।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিবাহবিচ্ছেদ চাইলে সিটি করপোরেশন বরাবর আবেদন করতে হয়। এর পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আবেদনকারী ও বিবাদী দুই পক্ষকেই প্রথমে আপসের নোটিশ পাঠায়। তবে আপসের ঘটনা খুবই কম ঘটে বলেও জানান কর্মকর্তারা। তারা বলেন, দু-একটি ঘটনায় হয়তো আবেদনকারী ও বিবাদী উপস্থিত হন। তবে ৯০ দিনের মধ্যে আপস বা তালাক প্রত্যাহারের আবেদন না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট প্রবীণ কর্মকর্তারা বলেন, গত এক যুগ ধরে মেয়েদের তালাকের আবেদনের প্রবণতা বেড়েছে। মূলত আগে মেয়ের তালাক হলে সমাজে নানা আলোচনা হতো, সমাজ মেয়েকেই দোষী ভাবত। এমনকি পরিবার মেয়েকে আশ্রয় দিতে চাইত না। এখন সামাজিক সচেতনতা বাড়ায় পরিস্থিতি বদলেছে। মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হয়েছে। ফলে খেয়ে বাঁচার জন্য স্বামীদের ওপর নির্ভরতা কমেছে। পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরিবারও মেয়েকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে স্বামীদের তুলনায় স্ত্রীরা বেশি তালাকের আবেদন করছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, বিয়ে যেমন সমাজের একটা অংশ, বিচ্ছেদও তাই। কিন্তু আমাদের সমাজ বাস্তবতায় বিচ্ছেদকে ভিন্নভাবে দেখি। বর্তমানে নারীরা বেশি বিচ্ছেদের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। নারীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। যখন কর্মজীবী নারীরা পরিবারে নির্যাতনের শিকার হন, সেক্ষেত্রে তারা এটা মেনে নেন না।
ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণের কারণে মানুষ এখন বেশি সচেতন। নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে পুরোপুরি জানে। এক্ষেত্রে চাইলেও তাদের ওপর যে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া এক সময় উপার্জনের কথা চিন্তা করে ছেলেদেরই গুরুত্ব দেওয়া হতো। এখন সময় বদলেছে। স্ত্রীরাও অনেক পরিবারে উপার্জনক্ষম। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জটিলতা নিরসনে উন্নত রাষ্ট্রে নানা রকম কাউন্সেলিং সেবা রয়েছে। যখন সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী জটিলতা অনুভব করে তখন তারা এ সেবাগুলো নেয় এবং তারা ভালো থাকে। কিন্তু আমাদের দেশ বহু এগোলেও এ ধরনের সেবা চালু হয়নি। এ ছাড়া পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য তো রয়েছেই। যেসব পরিবারে পুরুষ উপার্জনক্ষম সেখানে এটা বেশি। আর আধিপত্যবাদী মনোভাব নিয়ে কোনো সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তিনি বলেন, শহরগুলোয় নারীরা যেমন বেশি তালাকের আবেদন করছে, ভিন্নচিত্র কিন্তু গ্রামে। শহরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্ত্রীরাও উপার্জনক্ষম হওয়ায় তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু গ্রামে এটা হয় না। ফলে নির্যাতন সহ্য করেও তারা তালাকের দিকে যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারও তাদের আশ্রয় দিতে চায় না।
Leave a Reply