আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো না কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানারকমের ইস্যু নিয়ে মাঝে মাঝেই আন্দোলন হয়ে থাকে। গণমাধ্যমে উঠে আসে উপাচার্যদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দ্ব›দ্ব-সংঘাত। আন্দোলনের ফলে ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে, নষ্ট হয় শিক্ষার পরিবেশ। অনেকেই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের মেধা, মনন বিবেচনা করা হচ্ছে না। দেশের উচ্চশিক্ষাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নিয়োগ করতেন সেটিও অনুসরণ করা হয়নি। কাজেই বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছেও নেই বর্তমান সরকারের শিক্ষাসংক্রান্ত কর্মকাÐ। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে প্রখ্যাত ব্যক্তিদের উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতেন। আর এখন উপাচার্য পদ লাভের জন্য যারা উপযাচক হয় তারাই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। কারণ এখন কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যের বিবেচনায় গুণে-মানে-যোগ্যতায় প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যারা ছাত্রছাত্রীদের কাছে কোনোদিন তেমন পরিচিত নন, গ্রহণযোগ্য নন। গ্রহণযোগ্য শিক্ষককে কেন উপাচার্য করা হয় না? গ্রহণযোগ্য নন এমন শিক্ষককেই কেন উপাচার্য করা হয়? এর পেছনে যে নগ্ন রাজনীতি আছে তার অবসান হওয়া দরকার।
এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে হবে। এমন একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় সামনে চলে এসেছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ঘটনার সুবাদে। ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ঘটনাপরম্পরা এখন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনে ঠেকেছে। অনশন এখন ভেঙেছে। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না; একটি জনবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখন শিক্ষার্থী বনাম উপাচার্য সংকটে অবরুদ্ধ।
সময়ের দাবি, উচ্চশিক্ষা মুক্তি চায়। শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন এখন তো মনে হয় বেশ যৌক্তিক। কারণ প্রাথমিক থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত এ দেশে এখন শিক্ষার সংখ্যা ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপ্তি নজরকাড়া; কিন্তু একই সমান্তরালে গুণবোধক গভীরতা উধাও। যা হোক এ মুহূর্তের কথা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে; বৃক্ষের একটি শাখা, গোটা বৃক্ষের বিবেচনা আপাতত থাক। শাবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা উসকে দিয়েছে ঠিকই, তবে এটাই তো প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও অন্তত অর্ধডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বনাম শিক্ষার্থী সংকট ক্যাম্পাসকে উত্তাল-অস্থির করেছে।
সংকট সামাল দিতে সরকারি পদক্ষেপ আশাজাগানিয়া নয়। ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে মাত্র; মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে শাবিপ্রবির ঘটনা ধারাবাহিকতায় সংযোজন, ভবিষ্যতের অশনিসংকেত রয়ে গেল। অবশ্য শাবিপ্রবির সংকটের দ্রæত ও সম্মানজনক সমাধান সরকার দিতে পারলে তা হবে আশাপ্রদ। স্মর্তব্য, তপ্ত ক্যাম্পাস কোনো সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক নয়; তপ্ত ক্যাম্পাস সরকার ও দেশের জন্য ভাবনা-মূর্তি।
জনবিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন মূল সমস্যা উপাচার্য (কজন ব্যতিক্রম ছাড়া)। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী-প্রতিষ্ঠানপ্রধান। বলা বাহুল্য, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ওপর প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী যদি নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েও শুধু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় দলান্ধ হয়ে ক্ষমতাসীন হন, তা হলে ক্ষমতাসীন দল আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠানটি অধঃপাতে যায়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সা¤প্রতিক ভাবমূর্তি তা-ই বলে।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি সম্পর্কে তার কথা হলো, ‘… বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যা সম্বন্ধে বিশেষ প্রীতি, গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকেই রক্ষা ও প্রচারের জন্য স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি’ (‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’)। আর এমনিভাবে ইউরোপের অনেক আগে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নালন্দা, বিক্রমশীলা ও তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তাদের উদ্ভব ভারতীয় চিত্তের আন্তরিক প্রেরণায় ও স্বভাবের অনিবার্য আবেগে’; যা বাংলাদেশের সা¤প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠার পেছনে সক্রিয় কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। চিত্ত, প্রেরণা ও স্বভাব নয়, বরং রাজনীতি এবং ব্যবসা (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে) প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তা বুঝতে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটো কথা প্রণিধানযোগ্য : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্বানের আসন চিরপ্রসিদ্ধ’ এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র।’ বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন এবং সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান; যার কর্মী-শিক্ষককে হতে হবে বিদ্বান ও জ্ঞানী। আহরিত বিদ্যা ও চিন্তা উৎসারিত ভাবনা শিক্ষকের চিত্তে প্রজ্ঞা (শহড়ষিবফমব) ও স্বজ্ঞার (রিংফড়স) সৃজন করবে। ফলে শিক্ষার্থী প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞার স্পর্শ পাবে। চিন্তাহীন (ঃযড়ঁমযঃষবংং) বিদ্যা শিক্ষার্থী বা সমাজ কারও হিত করে না। এজন্যই আলবার্ট আইনস্টাইন উচ্চারণ করেছিলেন উপলব্ধ সত্য : ‘ণড়ঁৎ রসধমরহধঃরড়হ রং সড়ৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঃযধহ শহড়ষিবফমব.’ যে প্রতিষ্ঠানে প্রজ্ঞার চর্চা হয়; প্রজ্ঞার সৃজন সঞ্চালন হয় তা-ই বিশ্ববিদ্যালয়।
জন হেনরি নিউম্যান বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা তাড়িত হয়ে বই লিখেছিলেন ঞযব ওফবধ ড়ভ ধ টহরাবৎংরঃু (লন্ডন : লঙ্গম্যান্স গ্রিন, অ্যান্ড কো., ১৯০৭)। তিনি অবশ্য অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণে স্নাতক পর্যায়ে পঠন-পাঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু জার্মান রীতিতে গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ গুরুত্ব পেয়েছে। সা¤প্রতিক সময়ে মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধিতে আছে শিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ এবং যা অবশ্যই বিশ্বমানের হতে হবে।
গবেষণা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করে। উপরন্তু গবেষণাহীন উন্নয়ন অকল্পনীয়; আর এ কারণে তৈরি হয়েছে শব্দযুগল জবংবধৎপয ধহফ উবাবষড়ঢ়সবহঃ (জ্উ)। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বসা¤প্রতিক ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ গবেষণার করুণ দশা চিত্রিত হয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের জনবিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)। এখানে গবেষণার জন্য আছে সেন্টার ফর হায়ার স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ। সেন্টারসংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে মুজিববর্ষে প্রকাশিত হবে বঙ্গবন্ধুর ওপর ইংরেজিতে বিশ্লেষণাত্মক জীবনী গ্রন্থ; পরবর্তী সময়ে মূল বইয়ের বাংলা অনুুবাদ প্রকাশিত হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়ারের ভবিষ্যৎ গবেষণার বিষয় হবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তির কেন্দ্র। উল্লেখ্য, চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তি না হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হয় না। সব মানুষের মধ্যে আলো আছে; কিন্তু তাদের সে আলোয় আলোকিত করতে হলে প্রয়োজন চর্চা ও প্রশিক্ষণ, আর সে কাজটিই করেন আলোকিত-প্রাণিত শিক্ষক। শিক্ষক নিজে আলোকিত-প্রাণিত হবেন, শিক্ষার্থীকে আলোকিত-প্রাণিত করবেন।
উপাচার্য নিয়োগ-পদ্ধতির রাজনীতিকরণ মূল সমস্যা। ১৯৭২-এর ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই খাতে (শিক্ষা) রাজনীতি না হওয়াই ভালো।’ এখন রাজনীতি, নোংরা রাজনীতি হয়। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘যারা যোগ্য ও সৎ তাদের অধ্যক্ষ, উপাচার্য করেছি।’ এখন কাদের এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে? সবার জানা, প্রথম শিক্ষা কমিশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জননন্দিত এবং বিশ্বস্বীকৃত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদা। আমার বিবেচনায় একমাত্র শিক্ষানীতি তার হাত থেকেই পেয়েছিলাম; পরের শিক্ষা কমিশনগুলো লোক দেখানো সময় ও অর্থের অপচয় মাত্র। ড. খুদা পাকিস্তানে চাকরি করতেন। তিনি বাংলাদেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জহুরি, জহর চিনতেন। তিনি জানতেন কাকে কোন দায়িত্ব দিতে হবে। আর জানা কথা, বঙ্গবন্ধু ভালো মানুষ সন্ধান করতেন।
সিলেটের সুরমা আর ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী দুটিতে ১৩ জানুয়ারির পর থেকে অনেক জল গড়ালো, কিন্তু শাবিপ্রবির সংকট কাটল না। ২৬ জানুয়ারি দুটি খবর পেয়ে একাধারে শঙ্কিত ও উল্লসিত হলাম। পত্রিকা থেকে জানলাম, সরকার ‘হার্ডলাইনে’। সরকার বেলাইনে আছে, ঠিক লাইনে আসতে হবে; ‘হার্ডলাইনে’ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে তাৎক্ষণিকভাবে, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। একটি বাংলা দৈনিকে কর্মরত একজন স্নেহভাজন সাংবাদিক জানাল, আজ সকালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে শিক্ষার্থীদের অনশনের ইতি হয়েছে, তবে আন্দোলন চলমান থাকবে। অর্থাৎ ড. জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণযোগ্য, তার কথা শিক্ষার্থীরা শোনে; উপাচার্যের কথা শোনে না। উপরন্তু ড. জাফর ইকবাল যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কেমন লোক উপাচার্য হওয়া উচিত। সরকার কী দেখল? এখন উচিত দ্রæত এ সংকট দূর করে বিপন্ন বিশ্ববিদ্যায়লকে উদ্ধার করতে হবে।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)
Leave a Reply