দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নানা হিসাব-নিকাশে জমে উঠেছে। গতকাল মধ্যরাত থেকে প্রচার শেষ; রাত পোহালেই ভোট। এবারের ভোটে মেয়র পদে লড়বেন ৭ জন। তবে মূল লড়াইটা হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভী ও বিএনপির সদ্য বহিষ্কৃত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলমের মধ্যে। এ লড়াইয়ে পারদ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যকার ‘শীতল বিরোধ’। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সেই বিরোধে প্রকাশ্যে নমনীয়তা দেখা গেলেও অন্তর্দ্বন্দ্ব কতটুকু কমেছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। বিরোধের বীজ থেকে গেলে নৌকার পালে খানিকটা ধাক্কা লাগারও শঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া সিটির প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে সাংসদ ও মেয়রের ঘনিষ্ঠখ্যাত কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সে ক্ষেত্রে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করায় ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনা না ঘটলেও ‘পছন্দের’ প্রার্থীকে জয়ী করতে পেশিশক্তি প্রদর্শন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় সুষ্ঠু ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এখন পর্যন্ত সংঘর্ষের খবর পাওয়া না গেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটের দিন সহিংসতার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মেয়র প্রার্থীরা।
সহিংসতার শঙ্কা প্রকাশ করে তৈমূর আলম বলেছেন, নির্বাচনের দিন যাতে বহিরাগতরা প্রবেশ করতে না পারে, বিভিন্ন জেলা থেকে যে লোকজন আনা হচ্ছে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য, তারা যেন নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চলে যায়- এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা জারি করুন।
এদিকে নৌকাকে পরাজিত করতে ‘দলের ভেতর ও বাইরের সব পক্ষ’ মিলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি বলেন, ‘এখানে কিন্তু আইভীকে পরাজিত করার জন্য অনেক পক্ষ এক হয়ে গেছে। সেই পক্ষটা ঘরের হতে পারে, বাইরেরও হতে পারে, সব মিলে গেছে। কীভাবে আমাকে পরাজিত করা যায়, কীভাবে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ভোটকে ঝামেলা করানো যায়।’
আইভী আরও বলেন, ‘সহিংসতা হলে আমার ক্ষতি হবে। আমার ভোটাররা আসতে পারবে না। আমি যদি বলি একটি পক্ষ তাই চাচ্ছে? আমার নির্বাচন সবচেয়ে বেশি জমজমাট। সেই জায়গাগুলোর মধ্যে হয়তো কেউ সহিংসতা করে ভোট কেন্দ্রে আসা বাধা দিতে পারে।’
এদিকে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি। নির্বাচনীসামগ্রী চলে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নেমেছে। সব মিলিয়ে আমরা সুষ্ঠু ভোটের জন্য প্রস্তুত।’ কোনো চাপ আছে কিনা- এমন প্রশ্নে মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘আমাদের ওপর কোনো চাপ নেই। বরাবরের মতো এবারও কমিশনের নির্দেশনা আছে ভোট সুষ্ঠু করতে হবে।’
আগামীকাল অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে মেয়র পদে ৭ জন, ২৭ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ সিটিতে প্রথমবার ৯টি ওয়ার্ডে ইভিএমে এবং বাকিগুলোয় ব্যালট পেপারে ভোট হয়। ২০১৬ সালে সব কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে এবং এবার ইভিএমে পুরো সিটিতে ভোট হবে। প্রথমবার নির্দলীয় প্রতীকে ভোট হয় এ সিটিতে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন চালুর পর এটি দ্বিতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ইসি জানায়, সিটি নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৭। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৪ ও মহিলা ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৪ জন।
নির্বাচনে আইভী-তৈমূর ছাড়াও মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী মাসুম বিল্লাহ্ (হাতপাখা), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি), খেলাফত মজলিসের এবিএম সিরাজুল মামুন (দেয়ালঘড়ি), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জসীমউদ্দীন (বটগাছ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কামরুল ইসলাম বাবু ‘ঘোড়া’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারাও সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মাওলানা মো. মাসুল বিল্লাহ। শঙ্কার কথা ব্যক্ত করে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে। এটা এর আগেও আমরা বলেছি। আপনাদের মাধ্যমেও জানাতে চাই ভোটের হিসাবটা যা আসে তা যেন দেওয়া হয়। আমরা আগেই বলেছি উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করলে আমরা প্রতিরোধ করব।’
প্রার্থীদের হয়রানি করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় রকমের কোনো হয়রানির সম্মুখীন হয়নি। বৃহস্পতিবার প্রচার কাজে আমাদের কয়েকটা মাইক ভেঙে ফেলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। এর পর থেকে পরিবেশ মোটামুটি শান্ত আছে।’
নাসিক নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জয়বাংলা নাগরিক কমিটির উদ্যোক্তা মো. কামরুল ইসলাম বাবু। তিনি বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে সবুজ, সুন্দর, সুশাসিত ও সচল শহর গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রায় ৭ মাস আগে তিনি নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ঐতিহ্যবাহী এ শহরকে পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে প্রচার চালাই। এভাবে নতুন ভোটার এবং নারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম্মুখীন হই। এর পর থেকে বারবার প্রতিহিংসার শিকার হই, যা এখনো অব্যাহত আছে।’
তবে অভিযোগ নেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির হাতঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী মো. রাশেদ ফেরদৌসের। আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। জনগণ এবং প্রশাসনের প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে। আমি আশা করি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটা সুন্দর নির্বাচন হতে যাচ্ছে।’ সূত্র জানায়, তিনি ভয়ে আছেন বলেই কোনো অভিযোগ দিতে চান না।
খেলাফত মজলিসের প্রার্থী এবিএম সিরাজুল মামুন সুন্দর নগর গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে সব মানুষের উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদের উন্নয়ন কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। নির্বাচন কেমন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমার প্রত্যাশা সুষ্ঠু নির্বাচনের। যদিও শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা আছে।’
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের বটগাছ প্রতীকের প্রার্থী জসীমউদ্দীনের মুঠো ফোনের নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। পুরো দিন চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এলাকাবাসী বলছেন, ভয়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছেন তিনি।
এদিকে ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী রুহুল আমিন মোল্লা জানান, বিভিন্ন প্রার্থী বিভিন্নভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মহসিন ভূঁইয়া ভোটারদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।
ভোট পর্যবেক্ষণে ৯ সংস্থা
নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান জানান, নাসিক নির্বাচনে ভোট পর্যবেক্ষণ করবে ৯ সংস্থা। এগুলো হলো- জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন, সমাজ উন্নয়ন প্রয়াস, তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা, তালতলা যুব উন্নয়ন সংগঠন, রিহাফ ফাউন্ডেশন, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন এবং মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা-মওসুস।
এদিকে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে প্রতিটি কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিজিবির ৫ হাজার সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৯২টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন এসআইসহ ৫ জন পুলিশ, ৮ জন পুরুষ আনসার ও ৪ জন মহিলা (পিসি/এপিসি) দায়িত্ব পালন করবেন। এ হিসাবে ভোটকেন্দ্রের পাহারায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন হাজার সদস্য। ভোট কেন্দ্রের বাইরের এলাকার নিরাপত্তায় থাকবে পুলিশ, এপিবিএন, আনসার, বিজিবি ও র্যাব। প্রতি দুই ওয়ার্ডে একটি করে বিজিবির ১৪ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হবে। সে হিসাবে এ বাহিনীর প্রায় সাড়ে চারশ সদস্য থাকবেন। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মোট ২৭টি র্যাবের টিম দায়িত্ব পালন করবে। তাদের সংখ্যা প্রায় তিনশ। এ ছাড়া পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের ২৭টি মোবাইল, ৯টি স্ট্রাইকিং ও ৪টি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্সও থাকবে। তাদের সদস্য সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সংখ্যার বাইরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হতে পারে।
জানা গেছে, বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি দেখভালে ৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। গতকাল থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সংখ্যা বাড়িয়ে ২৭ করা হয়। এ ছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন ১৪ জন। তারা ভোটের পরও দুদিন মাঠে থাকবেন। এ ছাড়া ১৪ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে ১৮ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় সব বৈধ অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ থাকবে। নির্বাচনী প্রচার শেষ হবে ১৪ জানুয়ারি রাত ১২টায়। ওই সময়ের পর যাতে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ না হয়, সে জন্য পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে।
নারায়ণঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মাদ জায়েদুল আলম বলেন, ভোটের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখতে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর সুযোগ রাখা হবে না। তিনি বলেন, ১৯২টি ভোট কেন্দ্রকেই অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
আচরণবিধি ভেঙে আইভীর প্রচারে এমপি বাবু
আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আইভীর প্রচারে যোগ দেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু। গতকাল বিকাল ৩টায় নারায়ণগঞ্জের ২নং রেলগেটের অস্থায়ী মঞ্চে সভা শুরু হয় আইভীর। সভা চলাকালে মঞ্চে আসেন নজরুল ইসলাম বাবু। এ সময় স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেন তিনি। পরে বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটে সভাস্থল ত্যাগ করেন তিনি।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ২২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্বাচনী প্রচারে বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে। ২০০৪ সালে আচরণবিধিতে এ ধারা সংযোজন করা হয়। তবে তা অমান্য করে এর আগেও কয়েকবার প্রকাশ্যে আইভীর প্রচারে অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে।
এর আগেও ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলিসহ একাধিক এমপি নির্বাচনী আচরণবিধি উপেক্ষা করে প্রচারে অংশ নেন।
Leave a Reply