নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এবার তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন হচ্ছে। এর আগের দুবারই মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে লড়াইয়ে নেমেছেন। বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী আইভী বলেছেন, এবার হয়তো নানা কারণে পরিস্থিতি একটু কঠিন, তবে জয় নিয়ে শঙ্কা নেই। তার এবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা। নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে ছিলেন। বিএনপি বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তৈমূর আলম খন্দকার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করছেন। ফলে তাকে প্রথমে জেলা আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি এবং পরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রায় সবাই তৈমূরের সঙ্গে আছেন। তাদের ব্যাপারে দলের সিদ্ধান্ত অস্পষ্ট। তৈমূর আলম খন্দকার নিজে বলেছেন, দলের সিদ্ধান্তে তিনি খুশি। এখন আর নির্বাচনের আগে কেউ তাকে ‘বসিয়ে’ দিতে পারবে না। ২০১১ সালের নির্বাচনেও তৈমূর আলম খন্দকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু ভোটের আগে তিনি সরে দাঁড়ান। এখন বলছেন, তাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিএনপি দ্বৈতনীতি নিয়ে চলছে। একদিকে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তারা দলীয়ভাবে এই সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু অনেক জায়গায় বিএনপির পরিচিত নেতারা ধানের শীষ প্রতীক ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে অন্য প্রতীকে নির্বাচন করছেন এবং এই দুর্দিনে জয়লাভ করছেন। যারা জয়লাভ করছেন তাদের দল থেকে বহিষ্কারের কোনো খবর জানা যায়নি। জিতলে দলের জয়, হারলে দলের দায় নেই- বিএনপির এই নীতি দলের মধ্যে এবং দলের বাইরে সমালোচিত হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও বিএনপি একটি সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তৈমূর আলম খন্দকার স্থানীয়ভাবে একজন পরিচিত ও জনপ্রিয় নেতা। ভোটে দাঁড়ালে তিনি দ্রুত জমিয়ে ফেলতে পারেন। এবারও তাকে নিয়ে আগ্রহ ও আলোচনা দুটোই আছে। তবুও আনুষ্ঠানিকভাবে দল তার পক্ষে নেই। তাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও দল থেকে বহিষ্কারের কোনো খবর জানা নেই। অর্থাৎ তিনি বিএনপির সদস্য আছেন। তবে যেহেতু দলীয়ভাবে তিনি নির্বাচন করছেন না, তাই দলের মার্কা ধানের শীষ তার নেই। তার মার্কা হাতি। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা কিন্তু তৈমূরের সঙ্গেই আছেন। তিনি একই সঙ্গে বিএনপি এবং সর্বদলীয়। তৈমূর আলম খন্দকার বলেছেন, তিনি সবার প্রার্থী। জনগণের দাবিতেই নাকি তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। কী হবে নির্বাচনের ফল? এই প্রশ্নের জবাবে একজনকে এখনই জয়ের মালা পরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
নারায়ণগঞ্জে ভোট হবে ১৬ জানুয়ারি। এখনো প্রচার-প্রচারণা সেভাবে জমে ওঠেনি। শেষ মুহূর্তে আমাদের দেশে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। শুরুতে যাকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে মনে হয়, শেষের দিকে তাকেই হয়তো পেছনে দৌড়াতে দেখা যায়। তবে নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভী একজন জনপ্রিয় প্রার্থী। সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে পৌরসভার নির্বাচনেও তিনি জিতেছিলেন। তার পর দুই দফায় সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয়বারও তারই জয়ের সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১১ সালে আইভী ছিলেন নির্দলীয় প্রার্থী। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন শামীম ওসমান। সেবার সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়নি। আইভী ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮টি। আর শামীম ওসমান পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ের মালা গলায় পরেছিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ২০১৬ সালের নির্বাচন হয় দলীয় প্রতীকে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন আইভী। ভোট পান আগেরবারের তুলনায় একটু কম- ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান পান ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। ভোটের ব্যবধান দ্বিতীয়বার কিছুটা কমলেও আইভীর জনপ্রিয়তা কমেছে বলে কেউ মনে করছে না।
১৮ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি হয়ে আছেন আইভী। এবার কি নারায়ণগঞ্জবাসী পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন? তৈমূর আলম খন্দকার একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে সিটি মেয়রের পদে বসাতে কতভাগ মানুষ মানসিকভাবে প্রস্তুত তা বলা মুশকিল। তার পক্ষে যেমন কথা আছে, বিরুদ্ধে বলার কথাও আছে।
তৈমূর আলম খন্দকারকে ভোট দেওয়ার আগে মানুষ হয়তো দুটি বিষয় ভাববে। এক. তিনি বিজয়ী হলে কি ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হবে? তিনি মেয়র নির্বাচিত হলে কি উন্নয়ন কাজে সরকারের সমর্থন বা সহযোগিতা পাবেন? এই দুই প্রশ্নের জবাব নেতিবাচক হলে মানুষ কেন তৈমূর আলম খন্দকারকে ভোট দেবে? তৈমূরকে সর্বদলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা চলছে সেটাও তার জন্য কতটা হিতকর হবে তা বলা যায় না। কেন্দ্রীয় বিএনপি যদি তৈমূরের পক্ষে না থাকে তাহলে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে দোদুল্যমানতা দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে আইভী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক নৌকা পেলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন তার দিকে নেই। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত। সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সমর্থকের সংখ্যা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে বেশি। তবে আইভীর পক্ষেও সমর্থন আছে। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে দুই পরিবারের প্রভাব নিয়ে মতভিন্নতা পুরনো। ওসমান পরিবার এবং চুনকা পরিবারের দ্বন্দ্ব নিরসনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। ওসমান পরিবারের শামীম ওসমান এবং চুনকা পরিবারের সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যে বিরোধও নতুন কিছু নয়। এবারের নির্বাচনেও শামীম ওসমানের সমর্থকরা এখনো সেভাবে নির্বাচনী প্রচারে আইভীর পক্ষে নেই। তবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আইভীর পক্ষে থাকার জন্য, তাকে জিতিয়ে আনার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। শামীম ওসমান ও সমর্থকদের ওপর এসব হুশিয়ারি প্রভাব ফেলবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খোকন সাহা আইভীর নাম ভাঙিয়ে টাকা দাবি করায় আইভী নিজেই তার শাস্তি দাবি করেছেন। নৌকা ঠেকাতে নৌকার লোকজনই যদি তলে তলে কাজ করে তবে সেটা ভালো খবর নয়। অবশ্য আগেও কোনো নির্বাচনে শামীম ওসমানের সমর্থন না পাওয়ায় আইভীর জয়লাভে কোনো সমস্যা হয়নি। এবার হবে, তেমন আশঙ্কা প্রবলভাবে আছে বলেও মনে হয় না।
এবার আইভীর চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় মানুষের মধ্যে কিছু বিরূপতা তৈরি হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। মানুষ ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিন পছন্দ করে না। আওয়ামী লীগ শাসক দল হিসেবে অন্য দলের তুলনায় খারাপ নয়- এটা মুখে স্বীকার করেও কেউ কেউ পরিবর্তন চায়। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন আগেরবারও করেছেন। তাই এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা আছে। ভোটারদের মধ্যে আইভীর প্রশ্নে এক ধরনের আবেগ কাজ করে বলে শোনা যায়। দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকলে কিছু না কিছু বদনাম না হয়ে যায় না। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অনিয়ম করা জনপ্রতিনিধিদের একটি স্বাভাবিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দায়িত্ব পেয়েছেন অথচ কোনো অনিয়মের সঙ্গী হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু আইভী ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো কালি ছড়াতে দেখা যায় না তার বিরুদ্ধবাদীদেরও।
মেয়র পদে মোট ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আইভী এবং তৈমূর ছাড়া অন্য প্রার্থীদের নিয়ে গণমাধ্যমে কম আলোচনা। তবে প্রচারণায় আছেন ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, কল্যাণ পার্টি এবং খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থীরা। হেফাজতে ইসলাম অবশ্য তৈমূর আলম খন্দকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ইসলামি দলগুলো যদি শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে সক্রিয় থাকে তা হলে আইভীর জন্য ভালো। শেষ পর্যন্ত আইভী ঠেকানোর স্লোগান যদি না ওঠে তা হলে আইভীর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ম্লান না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক ভোটারের কাছে আইভীর একটি আলাদা ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। আইভী নিজেই একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় বড় কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে কিছু সংশয় আছেই। মানুষ নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কিনা, সে প্রশ্নও আছে। নারায়ণগঞ্জ ঢাকা থেকে বেশি দূরে নয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এমন কিছু যেন না ঘটে যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে সহায়ক হয়।
বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply