সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি কথা হাদিস নামে প্রচলিত আছে যে, ‘নারীকে পুরুষের মাথার হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়নি যে সে পুরুষের ওপর রাজত্ব করবে, পায়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়নি যে তাকে অবজ্ঞা করা হবে, বরং তাকে পাঁজরের হাড়ে তৈরি করা হয়েছে যাতে পুরুষ তাকে বুকের কাছাকাছি রাখে।’
কিন্তু একথা নিতান্ত বানোয়াট, হাদিসের নামে জালিয়াতি, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো এমন কথা বলেননি।
তবে কুরআনে শুধুমাত্র প্রথম মানব হজরত আদম (আ)-এর ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে একই ‘নফস’ থেকে বিবি হাওয়াকেও সৃষ্টি করা হয়েছে।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে একই ‘নফস’ থেকে। অতঃপর তা থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন। (সুরা যুমার, আয়াত ৬)
অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে: হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ‘নফস’ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (সুরা নিসা, আয়াত ১)
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে কতিপয় মুফাসসির বলেন যে, ‘তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন’ বলে এখানে উদ্দেশ্য বিবি হাওয়া (আ.), যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদমের বাম পাঁজরের হাড় থেকে। তখন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। জাগ্রত হয়ে যখন তাকে দেখলেন, তখন বিস্মিত হলেন এবং তার প্রতি প্রীত হলেন। তিনিও আদম (আ.) এর প্রতি প্রীত হলেন। (তাফসির ইবন কাসীর ২/২০৬; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৭৩১)
এবং প্রসঙ্গক্রমে আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি হাদিস এনেছেন, হাদিসের ভাষ্য এমন: আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। কাজেই নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৩৩৩১)
কিন্তু এই হাদিসে নারীদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির কথা এসেছে। কিন্তু কার পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে— তা স্পষ্ট করা হয়নি।
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি বলেন, ‘পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে’ হাদিসের এই ভাষ্য দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হজরত আদম (আ) ঘুম থেকে জেগে হঠাৎ দেখলেন বিবি হাওয়া তার বাম পাশে বসে আছেন। পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট হওয়া দ্বারা এটাই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ বিবি হাওয়াকে তিনি এমনভাবে দেখেছিলেন, যেন তার বাঁ দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছে। (ফয়জুল বারি, ৪/৩৪৩)
নাসিরুদ্দিন আলবানি বলেন, এই হাদিসে ‘পাঁজরের হাড়’ বলে আক্ষরিক অর্থে পাঁজরের হাড় উদ্দেশ্য নয়, বরং রূপকার্থে। এবং বিবি হাওয়া হজরত আদমের হাড় থেকে সৃষ্ট এই বিষয়ে কোনো সহিহ ও হাসান হাদিস নেই। (সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দায়িফাহ ওল মাওদুআহ)
ইন্দোনেশিয়ান আলেম ও দার্শনিক আবদুল মালিক করিম আমরুল্লাহ, যিনি হামকা নামে প্রসিদ্ধ, তিনি তার তাফসিরে উল্লেখ করেন যে, ‘বিবি হাওয়াকে আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির কাহিনি হিব্রু জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত ইহুদিদের তৈরি রূপকথা ছাড়া অন্য কিছু নয়। (তফসিরুল আযহার)
মুহাম্মদ আবদুহ-এর মতে তাফসিরের কিতাবে এই কাহিনি বাইবেলের পুরাতন নিয়ম থেকে সংগৃহীত গল্পমাত্র। (আল আমালুল কামিলাহ) মিশরীয় স্কলার রাশিদ রিদাও একই কথা বলেন।
এবং আমরা যদি বাইবেলের ‘বুক অফ জেনেসিস’ পড়ি, তার স্পষ্ট প্রমাণও পেয়ে যাই :
তখন প্রভু ঈশ্বর সেই মানুষটিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করলেন। মানুষটি যখন ঘুমোচ্ছিল তখন প্রভু ঈশ্বর তার পাঁজরের একটা হাড় বের করে নিলেন। তারপর প্রভু ঈশ্বর যেখান থেকে হাড়টি বের করেছিলেন সেখানটা চামড়া দিয়ে ঢেকে দিলেন। প্রভু ঈশ্বর মানুষটির পাঁজরের সেই হাড় দিয়ে তৈরি করলেন একজন স্ত্রী। তখন সেই স্ত্রীকে প্রভু ঈশ্বর মানুষটির সামনে নিয়ে এলেন। এবং সেই মানুষটি বলল, অবশেষে আমার সদৃশ একজন হল। আমার পাঁজরা থেকে তার হাড়, আর আমার শরীর থেকে তার দেহ তৈরী হয়েছে। যেহেতু নর থেকে তার সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু ‘নারী’ বলে এর পরিচয় হবে। (আদিপুস্তক, অধ্যায় ২, শ্লোক ২১-২৩)
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এই ধারণাগুলো ভিত্তিহীন ইসরাইলি বর্ণনা, যা মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা আদম থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন বলে একই উপাদান থেকে দুজনকে সৃষ্টি করেছেন বুঝিয়েছেন, বিবি হাওয়াকে আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট করা হয়েছে একথা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। এবং একথাও সম্পূর্ণ বানোয়াট যে নারীদেরকে স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
হাদিসে যে ‘পাঁজরের হাড়ের’ কথা বলা হয়েছে, এটি কেবল একটি উপমা। নারীদের সাধারণত কথায় আচরণে একটু বাঁকা স্বভাবের হয়। এটি সর্বক্ষেত্রে তাদের দোষ নয়, অনেক ক্ষেত্রেই সৌন্দর্য।
পাঁজরের হাড়ের গঠন বাঁকা ও অসমান প্রকৃতির। নারীদের চিন্তাভাবনা পুরুষদের মতো নয় বরং অনেকটাই আলাদা। তাই তাদের সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
তারা কখনো আবেগপ্রবণ কখনো খুব যৌক্তিক, কখনো খুব দয়ালু কখনো খুব কঠোর, তাদের মানসিকতা খুব দ্রুত বদলায়, তাই কারও জন্য উচিৎ নয় একজন নারীর কাছ থেকে সবকিছু নিঁখুত আশা করা। বরং সংসারজীবনে তাদের ভুল ও সীমাবদ্ধতাগুলো বোঝে সেই অনুযায়ী বসবাস করা। তাদের সঙ্গে ভালো ও সহনশীল আচরণ করা, এমনকি এর বিপরীতে তারা মন্দ আচরণ করলেও।
কুরআনে সুরা নিসার ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক যেমন বলেন, ‘তোমরা তাদের (নারীদের) সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর। তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।’
এটাই আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের শিক্ষা। এবং এই শিক্ষা কার্যত বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কোনো বানোয়াট কথাবার্তা হাদিস নামে প্রচারের প্রয়োজন নেই, বরং কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই সঠিক দিকনির্দেশনা নেওয়া উচিত। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
সহায়ক:
১) The Creation of Women from the Perspective of Mufassirun and Muhaddithun Between Past and Present Scholars by Roshimah Shamsudin and Aiza Maslan Baharudin
২) ফয়জুল বারি আলা সহিহিল বুখারি, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৪৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুব আল ইলমিইয়াহ
Leave a Reply