1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন

জাতি কোন শিক্ষকদের কথা শুনবে?

সরওয়ার জাহান
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

ভদ্রতা ও সৌজন্য শিক্ষা পরিবার থেকে পেয়ে থাকলেও শিক্ষকের আচার-আচরণই অনেক বেশি প্রভাবিত করে শিক্ষার্থীদের। তাদের কাছে শিক্ষকের আদর্শই অনুকরণীয়-অনুসরণীয় যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। শিক্ষার্থীরা যখন খারাপ আচরণ করে, তখন বুঝতে হবে শিক্ষক তার আচার-ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে পারেননি। সমাজে দুর্নীতি অনৈতিকতা বিস্তারে অন্যতম প্রধান কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ চর্চার বিকাশ না হওয়া ও প্রকৃত শিক্ষকের অভাব। সামাজিক বাস্তবতার দৃশ্যত চিত্রই বলে দিচ্ছে তাদের ব্যবহার ও ব্যক্তিত্বে শিক্ষার্থীরা প্রভাবিত নয় অথচ সুন্দর সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য।

শিক্ষকসমাজ হলো আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়ার কারিগর। সুশিক্ষা একটি জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সমাজে আলোকিত মানুষ গঠনে একজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরি করার মাধ্যমেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন সম্ভব। যেহেতু শিক্ষকরা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরি করেন সেহেতু শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন একজন ভালো শিক্ষক, বিচারক, প্রশাসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী।

অমরা ওই ধরনের শিক্ষকের কথাই শুনতে চাই যারা সরকার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিভিন্ন নীতিমালায় নৈতিক আচরণবিধি মেনে চলেন। প্রত্যেক শিক্ষকের দেশপ্রেম, রাষ্ট্রীয় সংবিধানের প্রতি সম্মান, দেশীয় সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে উজ্জীবিত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও সুশাসিত স্বদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদেরকে সচেতন করবেন। একজন শিক্ষক শিক্ষা ও গবেষণামূলক বা পরীক্ষামূলক কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবেন। তবে এমন কিছু করবেন না যা রাষ্ট্র এবং সমাজের স্বার্থের পরিপন্থী। শিক্ষক সব শিক্ষার্থীর মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ জাগানো এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলবেন।

প্রত্যেক শিক্ষকের দেশের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকবে। ইতিহাসের প্রতিটি ইতিবাচক অর্জনের কথা যেমন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ’৯০-এর গণআন্দোলন, তরুণদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শিক্ষার্থীদের জানানো উচিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনা অর্থাৎ দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায়, নারী-পুরুষের সমান অধিকার ইত্যাদি মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকা চাই।

শিক্ষকের কাজ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তথা সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখা।

শিক্ষক কোনো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে বা প্রচারণা চালাতে পারেন না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও হতে পারেন না। নিজস্ব ধর্ম পালনে বা উপাসনালয়ে যাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভোগ করবেন। কিন্তু অন্য আদর্শ বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক মতামত বা প্রভাব বিশেষভাবে বর্জনীয়। তার পদ, প্রাতিষ্ঠানিক বা রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার করতে পারেন না।

অধিকার লঙ্ঘন, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বঞ্চনা ও নির্যাতন থেকে বিরত থাকাসহ সব শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ নিশ্চিত করবেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবককে কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন না করা। ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ, অর্থনৈতিক অবস্থান বা জন্মস্থানের কারণে কারো প্রতি বৈষম্য, কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের সুবিধা প্রদান না করা উচিত নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কোনো শিক্ষার্থীর সাথে কোনো শিক্ষক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না।

শিক্ষার্থী-সহকর্মী অথবা অন্য কারো সাথে কোনো অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন, দৃষ্টিকটু মেলামেশা বা অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনে উদ্বুদ্ধ বা প্ররোচিত করা যাবে না, অর্থাৎ একজন শিক্ষক সামাজিক রীতিনীতির মধ্যেই থাকবেন।

মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য, জুয়া, আত্মমর্যাদা বিঘ্নিত হয় বা সামাজিকভাবে হেয় বলে প্রতীয়মান এ ধরনের অনৈতিক কার্যক্রম থেকে একজন শিক্ষক বিরত থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক।

প্রত্যেক শিক্ষককে অবশ্যই শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিকভাবে যোগ্য হতে হবে। মানসম্মত দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ ও দুর্নীতিবিরোধী চেতনা সৃষ্টি করতে।

একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মনিষ্ঠ শিক্ষক নিজস্ব নৈতিক মূল্যবোধ উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উন্নত চরিত্র গঠনে, জনগণ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং দেশপ্রেম জাগ্রত করতে অবশ্যই সহায়তা করবেন। তার নিজ দায়িত্ব গুরুত্বসহকারে পালন করবেন। নিয়মানুবর্তিতা তার এক যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে।

শিক্ষকের আচরণ রূঢ় না হয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। পাঠদানে থাকবে সৌজন্যবোধ এবং শিষ্টাচার। আচরণে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষুদ্ধ, বেদনাহত বা অপমানিত না হয় এ বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতা উপেক্ষা করে মমতা, সহানুভূতিসহ সুকুমারবৃত্তিগুলোর প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা দরকার। অশুদ্ধ ভাষায় শিক্ষাদানে বিরত থাকা আবশ্যক। এ জন্য ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া; প্রত্যেক শিক্ষক মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য আদর্শ-বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার দক্ষতা অর্জন করা একজন শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য।

জোর না করে শিক্ষক এমনভাবে শিক্ষাদান করবেন যাতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সাথে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী এবং সৃজনশীল, দক্ষ ও পেশাদার মানবসম্পদে পরিণত হয়। মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত ধারা বা কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী করতে শিক্ষকদের উদ্যোগী হওয়া দরকার। শিক্ষককে কখনোই শিক্ষার্থীরা যেন ভীতিকর না ভাবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয়, নিরাপদ ও আনন্দময় করে তুলবেন। শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসকে জোরদার করতে তাদেরকে সম্মানের সাথে সম্বোধন এবং শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে সহযোগী ভূমিকা পালন করে পাঠদান করা দরকার। জাতীয় দিবসগুলোতে প্রত্যেক শিক্ষক নিজে উপস্থিত থেকেই শিক্ষার্থীদের এসব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করবেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ-সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন।

শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণকালে একে মহান পেশা হিসেবে গণ্য করা দায়িত্ব। পাঠদানে উচ্চতম মান বজায় রাখতে গতানুগতিক পদ্ধতি পরিহার করে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী, যুক্তিসম্মত বিষয়ে পাঠদান এবং নিত্যনতুন সমাজ উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করবেন যাতে তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে জ্ঞাত হতে পারেন। কোনোক্রমেই কারো বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা অভিযোগ আনবেন না। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে এবং অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও তিনি শুধু যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গোপনে সেটা জ্ঞাত করবেন। আত্ম-উন্নয়নের জন্য অন্যান্য শিক্ষক এবং অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করবেন। ব্যক্তিগত যেকোনো সমস্যা সমাধানকল্পে গোপনীয়তা বজায় রেখে পরামর্শকের ভূমিকা পালন করবেন।

শিক্ষক ব্যক্তিস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে পারেন না। একজন শিক্ষক তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে নিজের কাছে প্রাইভেট এবং কোচিং সেন্টারে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন না। প্রতিষ্ঠানের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে শিক্ষক আত্মপ্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, স্থানীয় জনগণই তাকে মূল্যায়ন করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেকোনো সাফল্যকে নিজের একক সাফল্য বিবেচনা না করে যৌথ সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

শিক্ষকতা শুধু একটি বৃত্তি বা পেশা নয় বরং এটি একটি আরাধনা। অতি পবিত্র দায়িত্ব। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। যদি একজন শিক্ষক বিধিনিষেধ মেনে চলেন এবং এর ইতিবাচক দিকগুলো প্রয়োগ করেন, তবেই তিনি যথার্থ শিক্ষকের ভূমিকা পালন করবেন। মানুষ গড়ার কারিগরদের কাছ থেকেই দেশ আশা করে নিবেদিত, আদর্শবান, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞানমনষ্ক আলোকিত মানুষ। তার আলাপে বা কথোপকথনেও থাকবে না কোনো অশ্লীলতা, সহিংসতা, উগ্রতা বা অশোভনীয়তা।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানুষ গড়ার কারিগরদের কারখানা। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভাজন করা যেমন বৈষম্য, তেমনি বেসরকারি শিক্ষার্থীদেরকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বাধা দেয়াও বৈষম্য সৃষ্টি করে যা অনৈতিক। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি করারোপ করা মানে, শিক্ষাকে বিভাজন ও বাণিজ্যে পরিণত করে মুনাফা অর্জনের পথকে আরো প্রশস্ত করা। নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়ার প্রত্যয়ে সবাইকে নিজ নিজ স্থান থেকে বিভাজন বৈষম্য পরিহার করে শুদ্ধ চর্চার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও
টেকসই উন্নয়নকর্মী

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com