ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গের পাশে বাউন্ডারির দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সুমাইয়া নামে এক মেয়ে। দুই চোখের পানিতে মুখের মাস্ক ভিজে একাকার। তবু থামছে না অশ্রু। বাকরুদ্ধ মেয়েটি কেঁদেই চলেছে। তার পাশে বসে চোখের জল ফেলছেন তার চাচি ও প্রতিবেশীরা। কাছে যেতেই মেয়েটির চাচি শারমিন বলতে লাগলেন, মেয়েটি আর কত কাঁদবে। ২৭ দিন ধরে কাঁদছে। মোবাইলে ছবি দেখে আর মাকে ফেরত আনতে বলে। আমরা কোথায় পাব ওর মাকে। একটু পর লাশ দেবে, তাও দেখা যাবে না। পুড়ে অঙ্গার হওয়ায় লাশের নাকি দেখার কিছু নাই। অনেকটা হাড্ডি আর কয়লার মতো। তবে দেখতে না পারি কবর তো দিতে পারব, এটাই আমাদের সান্ত¦না।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহত ফিরোজা বেগমের (৩৫) স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী (জা) শারমিন আক্তার গতকাল বুধবার দুপুরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথা বলেন। শুধু ফিরোজার মেয়ে সুমাইয়া কিংবা শারমিনই নয়, একইভাবে বিলাপ করতে দেখা যায় অন্যদের স্বজনদেরও। গতকাল সকাল থেকেই বেলা যত বেড়েছে, ততই শোকের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে মর্গের বাতাস। কান্না করবেনই-বা না কেন, নিহতদের লাশ বুঝে পেতে প্রায় একমাসের অপেক্ষা শেষ হয়েছে তাদের।
ডিএনএ টেস্টে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর দুপুর দেড়টা থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এক এক করে স্বজনদের কাছে ২৪টি পুড়ে অঙ্গার হওয়া মরদেহ বুঝিয়ে দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরিচয় শনাক্ত হওয়া বাকি লাশগুলোও আগামী শনিবার বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। মরদেহ হস্তান্তরের সময় জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে স্বজনদের ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। মরদেহ গোসল শেষে একবারে প্যাকিংয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। না খুলে এভাবেই কবর দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মরদেহ শনাক্তের জন্য শরীরের বিভিন্ন অংশের নাম লিখে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, নিহত ফিরোজার মেয়ে সুমাইয়ার পাশে যেতে আরও জোরে কান্না শুরু করে মেয়েটি। পরে ধীরে ধীরে বলতে থাকে, মাকে খুব দেখতে মন চাচ্ছে। কিন্তু দেখতে পারব না আর কখনই বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার চাচি শারমিন বলেন, নারায়ণগঞ্জের ভোলাকান্দা এলাকায় তাদের বাড়ি। সুমাইয়ার বাবা জাহিদ মিয়া দর্জির কাজ করেন। করোনাকালে সংসারের অভাব দূর করতে সেজান জুস কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন ফিরোজা। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া বলেন, মায়ের খুব স্বপ্ন ছিল আমাকে ডাক্তার বানানোর। আমি যেন মানুষের সেবা করতে পারি সেই কথা বলত। কতদিন হয়ে গেল মায়ের কাছে ঘুমাই না। পড়াশোনা করার কথাও কেউ বলে না।
চাচি শারমিন বলেন, ছোটবেলা থেকেই সুমাইয়া মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত। প্রথম শ্রেণি থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে রোল ১। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তিও পেয়েছে। ফিরোজার স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। জানি না ওর স্বপ্ন পূরণ করতে পারব কিনা। মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও সুমাইয়ার মাতৃ বিয়োগের হৃদয়বিদারক কান্না আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে।
মর্গের পাশে যে ঘরে ডিএনএ নমুনা দেওয়া স্বজনদের শনাক্ত করছে পুলিশ, ওই ঘরের দরজার পাশে গ্রিল ধরে কান্না করতে দেখা যায় এক মধ্যবয়স্ক নারীকে। হাতে আরেক নারীর ছবি বিলাপ করে বলছেন, তোমার পাখিরে কি বলে সান্ত¦না দিব আপা। শুধু বলে আম্মু কই। এত দিন বলছি, খালামনির বাসায়। আজ (গতকাল) লাশ নিয়ে কি উত্তর দিব। আমি তো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সান্ত¦না দেওয়ার মতো একটা কথা বলে যাইতা আপা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহত নাজমা বেগমের বোন মমতাজ বেগম। তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন নিহত নাজমার ভাই ফারুক হোসেন।
জানতে চাইলে ফারুক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, রূপগঞ্জের গাউছিয়া এলাকায় ছেলে নাজমুল হোসেন (১৩) ও মেয়ে পাখিকে (৬) নিয়ে ভাড়া থাকতেন নাজমা বেগম। রিকশাচালক স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ৬ মাস ধরে যোগাযোগ ছিল না। নাজমার ছেলে নাজমুলও সেজান জুস কারখানায় কাজ করত। নাজমার লাশ ডেমরার কোনাপাড়ায় ডগাই কবরস্থানে তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে বলেও জানান তিনি।
বোন মমতাজ বেগম বলেন, লাশ নিয়ে বাচ্চাদের কি সান্ত¦না দিব, কি বুঝ দিব। কারখানার গেটে তালা মেরে রাখায় আমার বোন বের হতে পারেনি। তালা খোলা থাকলে যেমনে হোক জানডা বাঁচাইতে পারত। কারখানা কর্তৃপক্ষের কারণেই আমার বোন মারা গেছে। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই।
অপরদিকে, ভাতিজা রাকিবের লাশ স্বজনরা বুঝে পেলেও ছেলে মো. হাসনাইনের (১২) লাশের অপেক্ষায় মর্গে বিলাপ করতে দেখা যায় হাসনাইনের বাবা ফজলুর রহমান ও মা নাজমা বেগমকে। যে ২৪ জনের লাশ হস্তান্তর করা হবে, সেই তালিকায় হাসনাইনের নাম না থাকলেও ছেলেকে এক নজর দেখার আশায় মর্গের সামনে বিলাপ করতে থাকেন তারা। হাসনাইনের মা নাজমা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আমার হাসনাইনকে কেউ ফেরত এনে দেয় না। কেউ একটু দেখতেও দেয় না। হাসনাইন কই আছে বলতে পারেন? আমি একটু দেখব। বাড়ির পাশে কবর দেব। প্রতিদিন কবর জিয়ারত করব। একটা বার দেখার সুযোগ করে দেন কেউ, বলেই কান্নায় লুটিয়ে পড়েন।
হাসনাইনের বাবা ফজলুর রহমান বলেন, তাদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। অগ্নিকা-ের ঘটনার ৬ দিন পরই হাসনাইনের বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেই ৬ দিন আর কখনো ফুরাবে না। আমার বাজান কামাই করতে এসে পরপারে চলে গেছে বলে সেও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নারায়ণগঞ্জেরর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম মাহফুজুর রহমান বলেন, হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ২৪ শ্রমিকের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্ত হওয়া বাকি মরদেহগুলো আগামী শনিবার হস্তান্তর করা হবে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২৪টি লাশের জন্যই পরিবারের কাছে দাফনকাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ থেকে জানা গেছে, অগ্নিকা-ের ঘটনায় পুড়ে অঙ্গার হওয়া ৪৮ জনের ডিএনএ পরীক্ষা করে ৪৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৪ জনের লাশ হস্তান্তর করা হলো। আগামী শনিবার আরও ২১টি লাশ হস্তান্তর করা হবে। বাকি ৩টি মরদেহের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলেও জানায় সিআইডি।
যাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে
নোয়াখালীর এনায়েত হোসেনের ছেলে মো. আয়াত হোসেন (১৯), গাইবান্ধার হাসানুজ্জামানের মেয়ে নুসরাত জাহান টুকটুকি, নেত্রকোনার কবির মিয়ার মেয়ে হিমা আক্তার, নেত্রকোনার আজমত আলীর মেয়ে তাকিয়া আক্তার, নরসিংদীর জসিম উদ্দিনের মেয়ে রিয়া আক্তার (৩০), পাবনার শাহাদত খানের ছেলে মোহাম্মদ আলী, কিশোরগঞ্জের নিজাম উদ্দিনের মেয়ে সাহানা আক্তার (১৮), একই জেলার খোকনের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৩৮), ঝর্ণা আক্তারের মেয়ে ফারজানা (১৪), সুজনের মেয়ে ফাতেমা আক্তার (১৫), গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মুন্না (১৬), স্বপন মিয়ার মেয়ে সাগরিকা সায়লা, আব্দুল কাইয়ুমের মেয়ে খাদিজা আক্তার (১৬), মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী সাহানা আক্তার (৪৪), তাহের উদ্দিনের ছেলে নাঈম ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের বেলাল হোসেনের মেয়ে মিতু আক্তার, একই জেলার সুমাইয়া আক্তারের মা ফিরোজা (৩৬), বগুড়ার নয়ন মিয়ার মেয়ে নাজমা খাতুন, হবিগঞ্জের আব্দুল মান্নানের মেয়ে ইসরাত জাহান তুলি, ডেমরার নাজমুল হোসেনের মা নাজমা বেগম (৩৫), নোয়াখালীর আবুল কাসেমের ছেলে রাশেদ (২৫), একই জেলার বাশারের ছেলে তারেক জিয়া (১৫), ভোলার কবির হোসেনের ছেলে রাকিব হোসেন (২১), গাজীপুরের লিলি বেগমের ছেলে রিপন মিয়া (১৮)
উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় আগুনের সূত্রপাত হয়। কারখানার ছয়তলা ভবনটিতে প্লাস্টিক, কাগজসহ মোড়ক করার প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সব ফ্লোরে। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ২০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। অগ্নিকা-ের সময় লাগিয়ে পড়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়। পরে ৪ তলার একটি এসি রুম থেকে আরও ৪৮টি অঙ্গার হওয়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সব মিলিয়ে এ ঘটনায় ৫১ জনের লাশ উদ্ধার হয়।
Leave a Reply