কেন বাঙালি মুসলমান জিন্নাহর বিতর্কিত দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনে অন্ধ আবেগে সমর্থন জানিয়েছিল এবং একইভাবে ১৯৪৬-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের বাক্সে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল? যেখানে রাজনৈতিক যুক্তি ও সঙ্গত বিচার ভাবনার কোনো অবকাশ ছিল না? কারণ একটাই। পশ্চাৎপদ-মুসলমান সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষাগত উন্নয়ন, প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার সুযোগ-সুবিধা অর্জন, প্রতিযোগিতাহীন স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তানের সহজ-সরল পথে লক্ষ্য অর্জন। মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমন একটি স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের।
ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের সঙ্গে তুলনায় আর্থসামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানদের কাছে জিন্নাহর এ রাজনৈতিক প্রস্তাব অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। উঠতি বঙ্গীয় মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান-ছাত্র-যুবকরা এ কারণে কি পাকিস্তান প্রস্তাবের মূলে নিহিত সাম্প্রদায়িকতার দিকটি আমলে আনেনি। তারা মন-প্রাণ দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শ্রম ও সময় ব্যয় করেছে অকাতরে। এমনকি প্রগতিচিন্তার ধারক-বাহক বড়সড় অংশও এ মোহ থেকে মুক্ত ছিল না। তাদের এ আচরণ রাজনীতি-সমাজতত্ত্বের বিচারে বিস্ময়কর বলতে হয়।
দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে কম সহিংসতার প্রকাশ ঘটেনি, কম রক্ত বয়নি, বিদ্বেষ-বিরূপতার প্রকাশ ঘটেনি। নির্মম অমানবিকতার রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে যথারীতি ভারতবর্ষের বিভাজন এবং তৃতীয় শক্তি ইংরেজ শাসনের চাতুর্যে ভারত ও পাকিস্তান এ দুই স্বতন্ত্র ভূখ-ের প্রতিষ্ঠা হিন্দু ও মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি এই অনৈতিক তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে।
বাঙালি মুসলমান জনস্তর পর্যন্ত মহাখুশি। খুশি উল্লিখিত ছাত্র-যুবক সমাজ। কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তানে যাওয়া এবং স্থানীয় উর্দুভাষী কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি উর্দুকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে যে অনমনীয় মানসিকতা প্রদর্শন করে, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানবাসীরা তাদের একাধিক জাতিসত্তা সত্ত্বেও বিরূপতা প্রকাশ করেনি, প্রতিবাদ জানায়নি। কারণ উর্দু ভাষা তাদের ব্যবহারে একেবারে অপ্রচলিত ছিল না।
সমস্যা হয়ে দাঁড়াল পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জন্য। যেমন তাদের মধ্য শ্রেণি, তেমনি সাধারণ জনশ্রেণি- উর্দু তাদের কারোর পক্ষেই বলা-কওয়া-লেখা কোনোদিকেই সুবোধ্য ছিল না। ব্যতিক্রম অতিসামান্যসংখ্যক অতি উচ্চশ্রেণির মানুষ, বিশেষত হাতেগোনা গুটিকয় জমিদার পরিবার।
‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’- এই ঘোষণা উচ্চারিত হতে থাকে পাকিস্তানের শাসকদের প্রতিটি স্তরে- একমাত্র রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের প্রতিটি শীর্ষস্থানীয় নেতার কণ্ঠে একই সুর- অবাঙালি, বাঙালি নির্বিশেষে। পূর্ববাংলার শিক্ষিত-অশিক্ষিত বাঙালি মুসলমান প্রাথমিক পর্বে বিশেষ কোনো বিরোধী প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি।
কেন করেনি? না করার বোধগম্য কারণ তারা তখনো পাকিস্তানি মৌতাতে আচ্ছন্ন। তারা ভাবছে, জিন্নাহর ঘোষণামতো পাকিস্তান তাদের সব আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধান করে দেবে, তাদের সব রকম উন্নয়ন-উন্নতির পথ খুলে যাবে। মুসলিম লীগ রাজনীতিকরা তো ইতোমধ্যে মন্ত্রিত্ব ও এমএলএ ইত্যাদি পদ পেয়ে গেছেন, তাদের আহ্লাদের শেষ নেই।
কিন্তু আকাশ ভেঙে পড়ে পূর্ববাংলার ছাত্র-যুবাদের মাথায়, যারা পাকিস্তানের প্রচারে ভুলে, লেখাপড়া ছেড়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের বড়সড় অংশ, সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে সচেতন অংশ, প্রগতিচিন্তার অংশই উর্দু রাষ্ট্রভাষার ঘোষণায় বিচলিত, চিন্তিত, ক্ষুব্ধ। সেই সঙ্গে একই ধারায় ক্ষুব্ধ শিক্ষক, রাজনীতিক, পেশাজীবী শ্রেণির ছোট্ট একটি অংশ, যারা রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে, মাতৃভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে, বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতি নিয়ে ভাবেন বা ভাবতে সক্ষম। যাদের চিন্তা মোটামুটি বিচারে যুক্তিসঙ্গত ও স্বচ্ছ। তারা একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষার দাবিটা মানার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
এ ছাড়া তৃতীয় একটি ছোট অংশ, মূলত শিক্ষক ও সাহিত্যকর্মী যারা শুদ্ধ ইসলামি মতবাদে ও রাষ্ট্রগঠনের আদর্শে বিশ্বাসী, তারা হিসাব-নিকাশ করে দেখলেন, তাদের আদর্শের পক্ষে সমর্থন পেতে এবং প্রচারে সাধারণ মানুষের বোধগম্য মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষা দরকার। তা না হলে জনগণের দাওয়ায় পৌঁছানো যাবে না।
দুই.
উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের একাংশে এভাবে সমস্যার রূপ নিতে দেখা দিল। শাসক শ্রেণির একের পর এক ঘোষণা, বিবৃতি, আচরণ- এক কথায় তাদের ভূমিকা পূর্বোক্ত ছাত্র-যুবাদের স্বপ্ন ভেঙে ফেলার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তাদের ভাবনায় পাকিস্তান সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা তাদের রাজনীতি সচেতন অংশের জন্য। অন্যদের জন্য সাধারণ প্রতিক্রিয়া- মাতৃভাষা বাংলা, সব বাঙালির মুখের ভাষা বাংলার কী হবে?
যদি প্রশ্ন ওঠে, এত রক্তপাত এবং এত উন্মাদনা নিয়ে পূর্বোক্ত যুক্তিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যে স্বপ্নের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, সেখানে সেই পাকিস্তানের ঊষালগ্নেই কেন রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়ে গেল? তাও মূলত ছাত্র-যুবাদের তৎপরতায়। গোটা ছাত্র-যুবসমাজের বিশাল অংশরই চিন্তা ও মানসিকতা রাতারাতি বিপরীত ধারায় বইতে থাকল কেন?
জবাবটা খুব সহজ এবং সোজা। মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো তাদের ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থই বড় করে দেখেছে। পাকিস্তান তাদের সে স্বার্থ পূরণ করেছে। কিন্তু বাঙালির জাতীয় স্বার্থ পূরণ করেনি। তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। উর্দুভাষী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের তোষণ করে তারা জীবনে খ্যাতি প্রতিষ্ঠাবিত্ত ও সমৃদ্ধি অর্জন করেই খুশি ছিল। বাংলার জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না, বিবেকে তাড়না বোধ করেনি।
কিন্তু তারুণ্যে-যৌবনে আদর্শিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধরা এদের বিপরীত পথে হেঁটেছে। স্বার্থের চিন্তায় কোনো বালাই ছিল না। আদর্শবাদীরা দায়বদ্ধতার টানে, অন্যরা মাতৃভাষার টানে বিজাতীয় ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ।
আহমদ রফিক
উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে উর্দুভাষীদের প্রাধান্য থাকবে, বাঙালিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু শিখে নিতে হবে, পাক্কা উর্দুতে প্রাধান্য কতজনের পক্ষে সম্ভব হবে। উর্দু যাদের নিজস্ব ভাষায় তারাই সবক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি। অবস্থা অনেকটা আগের মতোই গিয়ে দাঁড়াবে। তা হলে পাকিস্তান তাদের কী স্বপ্ন পূরণ করবে?
বিদেশি শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায় ছিল এগিয়ে, এখন পাকিস্তানে উর্দুভাষীরা থাকবে এগিয়ে- যেমন অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনে। তখন বোধহয় কারও কারও মনে হয়েছে কেন্দ্রীয় রাজধানীও তো পশ্চিম পাকিস্তানে, যা ঢাকা থেকে হাজার মাইল দূরে। তা হলে কী পাওয়া গেল পাকিস্তানে, কতটুকু পাওয়া গেল?
কাজেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে, হোক তা উর্দুর পাশাপাশি। এত বিচার-ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কি সংগ্রামী ছাত্র সবার মনে সচেতনভাবে উপস্থিত ছিল? যতদূর জানি, অনেকেরই মনে ছিল, যতটা না বাংলা নিয়ে, তার চেয়ে বেশি উর্দুর বিরুদ্ধে।
বিরোধিতাটা উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে নয়। রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে, যে অবস্থান তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য কেড়ে নেবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। আর এ উপলক্ষে ছাত্রসমাজের মনে উর্দুবিদ্বেষ জন্ম নিতে থাকে। অবশ্য সবার মধ্যে নয়, কিন্তু ছাত্রসমাজের বড় অংশে। এটা সুস্থ লক্ষণ ছিল না। তবে এর দায়টা পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ বাংলা ভাষা। পাকিস্তানি উর্দুভাষী শাসকশ্রেণির মধ্যে বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক বোধ থাকলে তারা উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে দ্বিধাবোধ করত না। কিন্তু তারা তা করেনি। মূলত উর্দুভাষিক উচ্চমন্যতায় এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতি বিজাতীয় বিরূপতাবোধের তাড়নায়।
বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে উর্দু-বাংলা নিয়ে যতই হীনম্মন্যতা থাকুক, তাদের সন্তানদের বৃহত্তর অংশে অর্থাৎ ছাত্র-যুবাদের মধ্যে তা ছিল না। তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠায় তারা লড়াইয়ের পথটাই বেছে নিয়েছিল। কিছুটা দেরিতে হলেও এ লড়াইয়ে সাফল্য অর্জিত হয় (১৯৫৬)। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে পূর্ববঙ্গে এ আন্দোলনের সুফল ছিল তাৎক্ষণিক। সেটা দুই ধারায়- একদিকে ভাষিক জাতীয়তাবাদী চেতনায়, অন্যদিকে সর্বজনীন স্বার্থে প্রগতিবাদী চেতনায়। দুটোরই প্রাথমিক কারিগর ছাত্র-যুব সমাজ।
Leave a Reply