ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ। সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। শারীরিক সক্ষম ও আর্থিকভাবে সচ্ছল প্রত্যেক মুমিন মুসলমান বায়তুল্লাহর কালো গিলাফ আর কালো পাথর ছুঁয়ে জীবনের সব অপরাধের জন্য ক্ষমা পেতে চান। যাদের চোখের জল আর মনের আকুতি কবুল হয় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।
করোনার প্রদুর্ভাবে এবার দ্বিতীয়বারের মতো সর্বসাধারণের জন্য হজ পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সৌদি সরকার। শিগ্গির এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে। হাজীদের জন্য খুলবে কাবার দুয়ার।
লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হবে আকাশ বাতাস-এমনটাই প্রত্যাশা সারা বিশ্বের বিশ্বাসী মানুষের। হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- আ. জ. ম. ওবায়দুল্লাহ্
কুরআনের আলোকে হজের গুরুত্ব : মহান আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আর তুমি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সব ধরনের (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের ওপর সওয়ার হয়ে দূরদূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখিরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে এবং রিজিক হিসাবে তাদের দেওয়া গবাদিপশুগুলো জবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তাদের ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে’। [সূরা হজ, ২২/২৭-২৮]।
হাদিসের আলোকে হজের গুরুত্ব : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপরে প্রতিষ্ঠিত ১. তাওহিদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তার বান্দা ও রাসূল। ২. নামাজ কায়েম করা ৩. জাকাত প্রদান করা। ৪. হজ সম্পাদন করা। ৫. রমজানের রোজা পালন করা’। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৮]।
হজের ফজিলত ও তাৎপর্য : ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করেছে, যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ থেকে ফিরবে সেদিনের মতো (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন’। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৫২১]। অর্থাৎ সে কবিরা-সগিরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সব গুনাহ থেকে ওইরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে, যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। [ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৩/৩৮২]
হজ ও ওমরাহকারীর দোয়া কবুল করা হয় : হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-
‘হজ ও ওমরাহকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দোয়া করলে তাদের দোয়া কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদের তা দেওয়া হয়। [মুসনাদে বাযযার, হাদিস: ১১৫৩]। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
হজের একমাত্র প্রতিদান জান্নাত : ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের (সগিরা গুনাহের) কাফফারাস্বরূপ। আর জান্নাতই হলো হজে মাবরুর বা কবুল হজের একমাত্র প্রতিদান’। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৭৭৩]।
হজের জন্য খরচ করার ফজিলত : হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘হজের জন্য খরচ করা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মতোই, যার সওয়াব সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।’ [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩০০০]।
হাজীর সম্মানে সবকিছুই তার সঙ্গে তালবিয়া পাঠ করে : ‘হজরত সাহল ইবনু সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-যখন কোনো মুসলিম তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার ডানে ও বামে পাথর, বৃক্ষরাজি, মাটি সবকিছুই তার সঙ্গে তালবিয়া পাঠ করে; এমনকি পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত (তালবিয়া পাঠকারীদের দ্বারা) পূর্ণ হয়ে যায়’। [সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৮২৮]।
হজ দরিদ্রতা ও গোনাহগুলো বিদূরিত করে : ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন-‘তোমরা হজ ও ওমরাহর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখ (অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে কর)। কেননা এ দুটি মুমিনের দরিদ্রতা ও গোনাহগুলো দূর করে দেয়, যেমন (কামারের আগুনের) হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে দেয়। আর কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়’। [সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৮১০]।
হজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল : ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপরে ইমান আনা। বলা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, কবুল হজ’। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৫১৯]।
হাজীরা আল্লাহর মেহমান : ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর মেহমান হলো তিনটি দল-আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকারী, হজকারী ও ওমরাহ্কারী’। [সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং ২৬২৫]।
হজের নিয়তকারীরা কোনো কারণে হজ করতে সক্ষম না হলেও নেকি পাবে : ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ, ওমরাহ কিংবা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হলো এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকি লিখে দেবেন’। [বায়হাকী, শু ‘আবুল ঈমান, হাদিস নং ৪১০০]।
তালবিয়া পাঠের ফজিলত : হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত-‘নবী করিম (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন হজ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, যে হজে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা হয় এবং কুরবানি করা হয়। [সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৮২৭]।
বায়তুল্লাহ তাওয়াফের ফজিলত : ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে ও শেষে দু’রাকাত নামাজ আদায় করবে, সে যেন একটি গোলাম আজাদ করল’। [ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ২৯৫৬]।
হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি-‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে সাতবার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে তার একটি গোলাম আজাদ করার সমান সওয়াব হয়। তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহ তার একটি করে গুনাহ মাফ করেন, একটি করে নেকি লেখেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন’। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৪৪৬২]।
হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করার ফজিলত : ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে, এ দুটি তার সব গোনাহ ঝরিয়ে দেবে’। [মু’জামুল কাবির, হাদিস নং ১৩৪৩৮]।
যমযমের পানি পান করার ফজিলত : তাওয়াফ শেষে দু’রাকাত নামাজান্তে মাতাফ থেকে বেরিয়ে পাশেই যমযম কূপ। সেখানে গিয়ে যমযমের পানি বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে পান করবে ও কিছুটা মাথায় দেবে। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত, হাদিস নং ৪২৬৮]। যমযমের পানি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হলো যমযমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগমুক্তি’। [ত্বাবারাণী, মু’জামুল আওসাত্ব, হাদিস নং ৩৯১২]।
বায়তুল্লাহে নামাজ আদায়ের ফজিলত : ‘হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অন্যত্র নামাজ আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) নামাজ আদায় করা এক হাজার গুণ উত্তম এবং মসজিদুল হারামে নামাজ আদায় করা অন্য মসজিদে নামাজ অপেক্ষা এক লাখ গুণ উত্তম’। [সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৯১৬]।
ইয়াওমে আরাফার ফজিলত : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘আরাফার অধিবাসীদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন এবং তাদের বলেন, তোমরা আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা এলোমেলো চুলে, ধুলোমলিন অবস্থায় আমার কাছে এসেছে’। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭০৮৯]।
হজ একটি ইবাদত, যা আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিশেষ মর্যাদা লাভ করা যায়। তাই প্রত্যেকের হজ পালন করা উচিত। আয়েশা (রা.) হজের বিধান জানার পর কখনো হজ ত্যাগ করেননি। হজের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে এর কার্যাবলি সম্পাদন করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে পৃথক পৃথক ফজিলত ও মর্যাদা রয়েছে। রাসূল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন-‘তোমার কষ্ট ও খরচের পরিমাণের ওপর তোমার সওয়াব প্রাপ্তি নির্ভর করবে’। [দারা কুতনি, হাদিস নং ২৭৬২]। সুতরাং আমাদের উচিত হজ সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি সম্পন্ন করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এর গুরুত্ব ও ফজিলত বুঝে তদানুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক পরিচিতি : মুহাদ্দিস, ছারছিনা দারুস্সুন্নাত জামেয়ায়ে নেছারিয়া দীনিয়া
Leave a Reply