নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ’র সেজান জুস কারখানায় কাজ করতেন মা পারভিন বেগম ও তার ১৪ বছরের মেয়ে তাসলিমা। গতকাল বৃহস্পতিবার একসঙ্গেই তারা কাজে যান। পারভিন কাজ করতেন সেজান জুস কারখানার দোতলায়, তাসলিমার কর্মস্থল ছিল চতুর্থ তলায়। ভয়াবহ আগুন ভবনজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে দোতলা থেকে লাফ দেন মা। চারতলা থেকে মিলছে না তাসলিমার কোনো সন্ধান।
লাফিয়ে পড়ার পর গুরুতর আহত হন পারভিন। উদ্ধারের পর তাকে ভর্তি করা হয় নারায়ণগঞ্জের একটি স্থানীয় হাসপাতালে। এদিকে, তাসলিমাকে এখনও খুঁজে পাননি তার বাবা বাচ্চু মিয়া। তার পরিবারের লোকজন ও উদ্ধারকর্মীরা ধারণা করছেন তাসলিমা আর বেঁচে নেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রুপগঞ্জের ওই কারখানার সামনে মেয়ের ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন বাচ্চু মিয়া। দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘মেয়েটার কোনো খোঁজ নাই। মনে হয় আগুনে পুড়ে আমার মা আর নাই। মেয়েটা কারখানায় ঢুকেও ফোন করছিল, বলছিল বাবা ভাত রান্না করা আছে পাতিলে তুমি খাইয়া নিও। ভাত আর কেমনে খামুরে মা। তুই কই রে মা, তুই কই।’
নিখোঁজ তাসলিমার মামা মোবারক হোসেন জানান, বাচ্চু মিয়ার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের জেলায়। রুপগঞ্জে নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া থাকেন। ২ বছর ধরে তাসলিমা সেজান জুস কারখানায় কাজ করে। তার মা পারভিনও গত এক বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করছিলেন। বাচ্চু মিয়া পেশায় রিকশাচালক, তার দুই মেয়ের মধ্যে তাসলিমা ছিল বড়।
বাচ্চু ও মোবারকের পাশেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন আরেক বৃদ্ধা ছমিরন। তার ১৮ বছরের নাতনীও নিখোঁজ গতকাল বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে ছমিরান জানান, তার নাতনির নাম আলেয়া খাতুন। তার ছেলে বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এরপর থেকে নাততিকে তিনিই মানুষ করেছেন। গত এক বছর থেকে এই কারখানায় কাজ করতো আলেয়া। নাতনীর কিছু দিন আগে বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নাতিন জামাইও পাশের একটি কারখানায় কাজ করে।
এদিকে, রুপগঞ্জের ওই কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
মামুন বলেন, ‘গতকাল এখানে একটি মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো তল্লাশি চালানো হচ্ছে, কেউ যদি কোনোভাবে প্রানে বেঁচে থাকে তাকে উদ্ধারেরও চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি, কল-কারখানা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের তদন্ত রিপোর্টে আগুন লাগার সঠিক কারণ বেরিয়ে আসবে। এখানকার সকল শ্রমিক ভাইদের ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করছি। যাতে কেউ মিথ্যা বা কোনো গুজব না ছড়ায় সেদিকেও নজর দিতে হবে।’
এ সময় কল-কারখানা অধিদপ্তরের পরিদর্শক নাসির উদ্দীন বলেন, এখানে কারও কোনো গাফিলতি ছিল কি না সেটা তদন্ত করা হচ্ছে। চার তলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত নেট বিছানো ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুস, কোমল পানীয় ও বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরির ওই কারখানায় আগুন লাগে। এরপর গতকাল রাতেই তিনজনের মৃত্যুর খবর জানায় স্থানীয় প্রশাসন।
Leave a Reply