1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৯ অপরাহ্ন

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি, এখন তবে কী করা?

ড. আর এম দেবনাথ
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১

‘অবসর গ্রহণের আগে মুদি দোকান দেওয়ার কথা ভাবছি।’ এটা আমার কথা নয়। আমার এক অতিপরিচিত বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের বেশ ভালো পদে চাকরিরত এক ভদ্রলোকের কথা। কারণ জিজ্ঞেস করাতে উনি বেশ বড় একটা ব্যাখ্যা দিলেন।

তার ভাষ্য হচ্ছে : যে টাকা বা সুবিধা নিয়ে অবসর নেবেন, তিনি তা খাটিয়ে সংসার চালাতে পারবেন না। ব্যাংক এখনই কোনো সুদ দেয় না। তিনি যখন অবসর নেবেন তখন হয়তো ব্যাংক উল্টো চার্জ করবে টাকা নিরাপদে রাখার জন্য। আবার সঞ্চয়পত্র কিনে দুটো বেশি টাকা সুদ হিসাবে পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সরকার ক্রমাগতভাবে এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। দুই লাখ টাকা আজকালকার দিনে কয় টাকা? এ পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কিনলেও ‘কর শনাক্তকরণ নম্বর’ (টিআইএন) লাগবে।

এদিকে কষ্টার্জিত অবসর সুবিধা শেয়ারবাজারেও নিয়োগ করা যাবে না। সুদে-আসলে বিনাশ হতে পারে। এমতাবস্থায় করণীয় কী? করণীয় হতে পারে খেয়ে-দেয়ে সব টাকা শেষ করে ফেলা। সেটা সম্ভব নয়। ফ্ল্যাট ক্রয় করতে গিয়ে তার ঋণ করতে হয়েছে। এর মাসিক কিস্তি আছে। দুটি ছেলেমেয়ে এখনো পড়াশোনা করছে। স্ত্রী গৃহিণী, তার কোনো রোজগার নেই। তাহলে করণীয় কী? মুদি দোকান দেওয়া ছাড়া গতি নেই।

আছে আরেকটি বিকল্প। ওষুধ বা স্টেশনারির দোকান দেওয়া। এসবে কিছু অভিজ্ঞতা লাগে। বেচা-কেনাতেও আছে অনিশ্চয়তা। মুদি দোকানে আর যাই হোক বেচাকেনা নিশ্চিত। ভোগ্যপণ্যের বাজার শত হোক। তার এসব ব্যাখ্যা শুনে জিজ্ঞেস করি, দেশের বাড়িতে কিছু আছে কিনা। বলল আছে, কিন্তু ওসব ভোগদখল করে যাচ্ছে আত্মীয়স্বজন। ওদিকে তাকানো যাবে না। অতএব, তার ‘ফল ব্যাক’ করার মতো কিছুই নেই। অল্প যে কয়টা টাকা নিয়ে অবসরগ্রহণ তা মুদি দোকানে লাগানোই শ্রেয়।

ভদ্রলোকের কথার বাস্তবতা তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। সে বছর দুয়েক আগের কথা। তখনো করোনার আক্রমণ শুরু হয়নি। করোনা এসে গেলে যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন। কিছুদিন আগে একটা কাজে আমার এক ছাত্রকে ফোন করি। সেও একটা নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো পদে চাকরি করত। কেমন আছ জিজ্ঞেস করাতে সে যে উত্তর দিল তা আমার বয়ানিতে নিুরূপ। সে এখন গেঞ্জির দোকানদার-ব্যবসায়ী। কেন?

অসময়ে তার চাকরি গেছে। আর মাত্র ৪-৫ বছর চাকরি ছিল। এরপরই অবসর নেওয়ার কথা। সেভাবেই ছিল তার প্রস্তুতি। চাকরি জীবনে কমপক্ষে ৫-৬টি পদোন্নতি পেয়েছে। ‘এচিভম্যান্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে কয়েকবার। পরীক্ষার রেজাল্ট উত্তম। চারটি পরীক্ষার মধ্যে দুটিতেই প্রথম বিভাগ-শ্রেণি। হঠাৎ তার চাকরি চলে যাওয়াতে সে বিপাকে পড়ে। অন্য প্রতিষ্ঠানে ঢোকার চেষ্টা করে বিফল হয়। এদিকে দুটি ছেলেমেয়ে এখনো অধ্যয়নরত। একটা গাড়ি ‘মেনটেইন’ করত। ড্রাইভার ছিল। মাসিক খরচ অনেক। তার পদচ্যুতি নিয়মিত নয়। তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

অতএব, যেসব স্বাভাবিক সুবিধাদি পাওয়ার কথা সে তা পায়নি। অফিসে তার ঋণ ছিল। ঋণের টাকা কেটে নিয়ে যে টাকা তাকে দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়। বড় ব্যবসা, অসম্ভব। আইটি খাতে ঢুকে কিছু করা যাবে না। কোম্পানি করে ব্যবসা করা, ব্যাংকের লোন জোগাড় করা এক কঠিন ব্যাপার। তদুপরি নেই মর্টগেজ দেওয়ার মতো কোনো সম্পত্তি। অগত্যা কী করা! নারায়ণগঞ্জে কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তাদের সহযোগিতায় সে এখন গেঞ্জি-হোসিয়ারি দোকানের মালিক। সংসার চলছে।

এসব দুঃখের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ও বলছিল, যদি এ গেঞ্জির ব্যবসাই করতে হবে ‘মাস্টার্স’ পরীক্ষা পাশ করে, তাহলে তো তা করতে পারতাম অনেক আগে থেকেই। চাকরির মোহ, বাবা-মায়ের তাগিদ, বিয়ে-সংসার ইত্যাদির কথা চিন্তা করে চাকরিতে ঢোকা। ভেবেছিল নিয়মিতভাবে অবসর নেবে। তা আর হলো না। যে টাকা নিয়ে চাকরিচ্যুত তা ব্যাংকে রেখে সুদের ওপর সংসার চালানো সম্ভব নয়।

উপরে যে দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম তা বাস্তব ঘটনা। অথচ আজ থেকে ১০-১৫-২০ বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১০-১৫ বছর আগেও ভালো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘রিটায়ার’ করলে সিনিয়র নির্বাহীরা মোটামুটি কোটি টাকার মতো পেত। কেউ কেউ একটু কম। যে টাকা তারা পেত তা দিয়ে তাদের মাসিক খরচ চলে যেত। যারা ৫০ লাখ টাকাও পেতেন তারা সেই টাকা ব্যাংকে রাখলে ১২-১৪ শতাংশ হারে সুদ পেতেন। আর সারা জীবনের কিছু সঞ্চয় থাকলে তা ব্যাংকে রেখে সর্বমোট মাসিক লাখখানেক টাকা হয়ে যেত।

তখনকার বাজার দরে এ টাকা অনেক টাকা। সেই তুলনায় আজকের দিনের অবস্থা কী? একজন মোটামুটি সিনিয়র নির্বাহী ভালো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিতভাবে অবসর নিয়ে যদি কোটিখানেক টাকাও পায়, তাহলে তা ব্যাংকে রেখে কত সুদ পাওয়া যাবে? সরকারের ‘নয়-ছয়’ সুদনীতির কারণে এখন কোটি টাকা ব্যাংকে রেখে বছরে কর কেটে পাওয়া যেতে পারে বড় জোর ৫ লাখ টাকা। মাসে হবে হাজার চল্লিশেক টাকা। এটা একটা গাড়ি রাখার খরচও নয়।

নিজের ফ্ল্যাট থাকলেও সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, মিউনিসিপ্যালিটি ট্যাক্স এবং বুয়া বাবদই মাসিক খরচ হবে কমপক্ষে ১৫-২০ হাজার টাকা। সবজির বাজার, মাছ-মাংসের বাজার, ফলমূল, দুধ-ডিমের খরচ এবং সর্বোপরি চিকিৎসা খরচ ধরলে আজকের বাজারে মধ্যবিত্ত সংসারের খরচ হবে মাসিক লক্ষাধিক টাকা। সঞ্চয়, সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়েও কিছু হওয়ার নয়।

আমি আলোচনা করছি মোটামুটি নির্বাহী শ্রেণির একজন কর্মকর্তার রোজগার ও খরচ নিয়ে। যারা আরও নিচে আছে তাদের কথা না বলাই ভালো। দেখা যাচ্ছে কোনো সঞ্চয়েই কোনো কিছু হওয়ার নয়। তাহলে কি মানুষ সঞ্চয় করবে না? বর্তমানে বাজার অর্থনীতির যে নমুনা সারা বিশ্বে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে মনে হয় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোনো দেশই সঞ্চয় চায় না। যা রোজগার তা খরচ করো। সুখে থাকো, আনন্দে থাকো।

টাকা বাঁচানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যদি টাকার দরকার হয় তা দেবে ব্যাংক-অবশ্যই ‘লোন’ হিসাবে। অবস্থা যা তাতে বোঝা যায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঋণের জালে আটকা থাকতে হবে। গরিব, অতিগরিব হলে রয়েছে সরকারের ‘সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা’। বাজার অর্থনীতির আগ্রাসনে যারা পেছনে পড়ে যাবে, তাদের ‘কাফফারা’ হিসাবে সরকার মাসে মাসে কিছু ভাতা দেবে। একান্ত গরিবদের জন্য বিনামূল্যে চাল-ডাল থাকবে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কী হবে তা বর্তমান ব্যবস্থায় কিছুই বলা হচ্ছে না।

মধ্যবিত্ত বড়ই বিপদে। প্রতিদিন তার রোজগার কমছে, চাকরিচ্যুতি, কর্মচ্যুতি ঘটছে। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়মিতভাবে অব্যাহত- তা এ কোভিডের ভীষণ দুর্দিনেও। কোনো ব্যবসায়ী মানুষকে রেহাই দিচ্ছে না। আগে মধ্যবিত্ত পাকিস্তান আমলে অবসরগ্রহণের আগে জায়গা কিনে শহরে বাড়ি করত, কেউ কেউ শহরের উপকণ্ঠে করত। নতুবা করত থানা হেডকোয়ার্টারে। স্বাধীনতার পর মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটের দিকে নজর দিল, জমির উচ্চমূল্যের কারণে। এখন ফ্ল্যাটও নিজের আয়ে সম্ভব নয়। ঢাকার উপকণ্ঠেও সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে আগে সস্তায় কিছু একটা আবাসনের মতো করা যেত।

রেমিট্যান্সের অঞ্চলে এখন জমি-বাড়ির দাম ঢাকার মতোই। কোথাও কোথাও ঢাকার চেয়ে বেশি। জমি-বাড়ি থেকে ফ্ল্যাটে, ফ্ল্যাট থেকে ছোট ফ্ল্যাটে মন দেওয়ার পরও মানুষ টিকতে পারছে না। অবসরের পর চিকিৎসা, ডাক্তার, টেস্ট ও হাসপাতাল খরচ লাগে। এসব এখন দুর্মূল্য। প্রাইভেট হাসপাতালে ঢুকলেই ২০-৩০ হাজার টাকা বেরিয়ে যায়। কয়েকদিনের ব্যাপার হলে তো কোনো উপায়ই নেই।

আগে মধ্যবিত্ত নিজে চলত, বেকার ভাইবোনদের দেখত, তাদের বিয়ে-শাদির ব্যবস্থা করত, বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখত, ফুপু-খালা ও বিধবা আত্মীয়স্বজনদের দেখত। এমনকি প্রতিবেশী গরিবদেরও দেখতে হতো। এসবই চাকরি সূত্রে মোটামুটি করা যেত। এখন কি এসব সম্ভব? না, বর্তমান রোজগার ও খরচে তা সম্ভব নয়। অথচ এসবের প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে? না, আদৌ নয়। আমাদের পারিবারিক-সামাজিক দায়িত্ব আগের মতোই আছে।

উন্নত দেশের মতো সরকার এসবের দায়িত্ব নেয় না। তারা ট্যাক্সও আদায় করে, নাগরিকদের প্রয়োজনে, বিপদে-আপদে সাহায্য করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সরকার শুধু ট্যাক্সের কথাই বলে। মধ্যবিত্ত যারা ট্যাক্স দেয়, বাজার অর্থনীতি তাদের জন্য কিছু করে না। হতে পারত বেকার ভাতার ব্যবস্থা, বয়স্ককালীন ভাতার সার্বজনীন ব্যবস্থা, হতে পারত চিকিৎসর ব্যবস্থা। না, এসব সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে একমাত্র সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারাই একটু চলে-ফিরে আছে। তা রিটায়ার করার পরও।

এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত বেকার, অবসরপ্রাপ্ত লোকজন, চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের উপায় কী? বাজার অর্থনীতি যখন লাখ লাখ মানুষকে পথে বসাচ্ছে, তখন বাঁচার পথ কী? মুদি দোকান, হোসিয়ারির দোকান, ওষুধের দোকান, স্টেশনারির দোকান ছাড়া পথ নেই! কিন্তু এসবও এখন সহজে করা যায় না। এসব ব্যবসাতেও এখন প্রচুর পুঁজি লাগে। অল্প পুঁজির ব্যবসা কোথায়? ছোট ছোট দোকানদারের কাজও ‘বিগ বিজনেস’ নিয়ে নিচ্ছে। মোয়া তৈরির ব্যবস্থাও এখন বড় বড় কোম্পানি করে। ওষুধের দোকান তো বটেই। তাহলে উপায়?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com