কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার সঙ্গে ঢুকছে ভয়ঙ্কর মাদক আইসের চালান। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাদক সিন্ডিকেট মিয়ানমার থেকে এসব চালান দেশে নিয়ে আসছে। এ ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফে নতুন মাদককারবারিদেরও উত্থান ঘটেছে। সীমান্তে দায়িত্বরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বেশ কিছু মাদক জব্দ করতে সক্ষম হলেও আড়ালে বড় চালানগুলো খালাস হচ্ছে এমন ধারণা স্থানীয়দের। টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা
ক্যাম্পসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা যায়, মাদককারবারিরা একসময় শুধু ইয়াবার বড় বড় চালান দেশে এনেছে। সম্প্রতি ইয়াবার পাশাপাশি আরেক ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের চালানও দেশে ঢুকছে। প্রথম দিকে আইস অপরিচিত হওয়ায় কারবারিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে কয়েকটি চালান পাচার করেছে।
গত দেড় বছরে রাজধানী ঢাকায় আইসের অন্তত চারটি চালান জব্দ করা হয়। তদন্তে জানা যায়, এই মাদকের প্রধান রুট টেকনাফ। গত ৩ মার্চ টেকনাফে দুই কেজি আইসসহ মো. আবদুল্লাহ নামে একজনকে গ্রেপ্তারও করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) টেকনাফ বিশেষ জোনের সদস্যরা। উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। উদ্ধারকৃত আইসের আনুমানিক মূল্য ছিল ৩ কোটি টাকা। পরে ১৩ এপ্রিল টেকনাফ শীলখালী চেকপোস্টে তল্লাশি করে বিজিবি সদস্যরা ১৬৭ গ্রাম আইসসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেন।
ডিএনসি সদস্যরা জানান, সম্প্রতি টেকনাফ র্যাব-১৫ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে এক কেজি আইসসহ মো. হামিদ নামে এক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে জানা যায়, আইসের চালানটি থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমার হয়ে সমুদ্রপথে বাংলাদেশে ঢুকেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে আইসের বড় বাজার নেই। তাই কারবারিদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আইসের চালান ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করা। ডিএনসি টেকনাফ বিশেষ জোনের দায়িত্বরত সহকারী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাদকসেবীরা ইয়াবার পরে যেটি গ্রহণ করছে তার নাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। এটি ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। আমরা টেকনাফ সীমান্তে অভিযান চালিয়ে মার্চে আইসের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ করেছিলাম। ইয়াবা, আইসসহ যে কোনো ধরনের মাদকের বিরুদ্ধে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সজাগ।
সীমান্তের সাধারণ মানুষ জানান, ইয়াবা কারবার এখন অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে ইয়াবা পাচার কিছুটা কঠিন। সে কারণে কারবাররা শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচর, দক্ষিণ পাড়া সৈকত পয়েন্ট, মাঝের পাড়া, সাবরাং হারিয়াখালী, কচুবনিয়া, মুন্ডারডেইল, খুরের মুখ, সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়া পাড়া, বাহারছড়ার নোয়াখালী, শীলখালী, শামলাপুর, উখিয়ার ইমামের ডেইল, ইনানী ও হিমছড়ি সৈকত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ও আইসের চালান খালাস করছে। মাছ ধরার ট্রলারে জেলের ছদ্মবেশে মাদক পাচারকারীরা সাগরে গিয়ে মিয়ানমার কারবারিদের কাছ থেকে এই চালান নিয়ে আসছে।
এ ছাড়া উখিয়া সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে পাচারকারীরা সরাসরি মাদকের চালান দেশে এনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মজুদ করছে। পরে সুযোগমতো মাদকগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। সাবরাং এলাকার বাসিন্দা আবদুল গফুর বলেন, ইয়াবা কারবারিরা এখন জেলে, পরিবহন শ্রমিক, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারে অর্থ লগ্নি করছে। কঠিন পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত জনপদ মাদকের রাজ্যে পরিণত হবে।
এদিকে আত্মসমর্পণকারী স্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের অনেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। গত ২৩ মে হ্নীলা ইউনিয়নের মেম্বার মো. জামালের ছেলে শাহ আজমসহ চার মাদককারবারিকে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করেছিল টেকনাফ থানা পুলিশ। ২০১৯ সালে মাদক কারবার ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণায় যে ১০২ জন কারবারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে আটক শাহ আজম ছিলেন।
এ বিষয়ে টেকনাফস্থ ২ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফয়সল হাসান খান বলেন, সীমান্তে মাদকের পাচাররোধে বিজিবি সব সময় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। নাফনদ সীমান্তে যেসব চালান ঢোকার চেষ্টা করেছে, তার বেশিরভাগই বিজিবির হাতে ধরা পড়ছে। তবে পাচারকারীরা এখন রুট ও কৌশল পাল্টে মাদক কারবার চালিয়ে যেতে তৎপর। বিজিবি সীমান্তে নজরদারির পাশাপাশি সড়কেও চেকপোস্ট স্থাপন করে মাদকের পাচার রোধ করার চেষ্টা করছে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অবস্থান বরাবরই কঠোর রয়েছে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। শিগগিরই চিহ্নিত কারবারিদের ধরতে অভিযান হবে।
Leave a Reply