আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো শিক্ষা। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণ এটি এবং শিক্ষার ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতিসত্তার কাঠামো। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন, জীবনের সব ক্ষেত্রে সব বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী ব্যক্তিত্ব তৈরি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। আজকের পৃথিবীর পিয়ন থেকে প্রেসিডেন্ট সবাই শিক্ষানুরাগী, সবাই শিক্ষিত হতে চান, সবাই নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করে থাকেন।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো- শিক্ষাকে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করা। এর পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গিও থাকা আবশ্যক। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি প্রথমেই তার জাতীয় আদর্শ সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বস্তুগত জ্ঞানের নৈতিক সমন্বয় সাধনই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালার সৎ বা সালেহ বান্দা তৈরি করতে হবে, যারা সবাই তাদের সব দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হবেন। শিক্ষার্থীদের জন্মগত যোগ্যতাগুলো বিকশিত করা, তাদের স্বভাবগত প্রবণতাসমূহ সঠিক খাতে প্রবাহিত করে দেয়া ছড়াও তাদেরকে মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক দিক থেকে ক্রমান্বয়ে এমন উপযুক্ত ও যোগ্য করে তুলতে হবে যাতে তারা আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে এবং ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে তাদের মালিক ও স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা পরিপূর্ণ পালন করতে পারে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি হলো আজকের পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, প্রায় সব মানুষই আজ শিক্ষানুরাগী; আমরা পাস করে শিক্ষিত হয়েছি। কিন্তু শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে গেছি। যেখানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জীবনমুখী হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমাদের জীবনব্যবস্থাই শিক্ষামুখী হয়ে গেছে। আজকের সমাজে পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পাস করে নিছক সার্টিফিকেট অর্জন। আমাদের বেশির ভাগ লোকই পড়ার দরকার তাই পড়ছে, পাস করার জন্য পড়ছে, চাকরির জন্য পড়ছে। কেউ কেউ আবার শুধু সনদের জন্য পড়ালেখা করছে।
শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক দৈন্য ও লক্ষ্যহীনতা আমাদের জাতীয় জীবনে ভয়াবহ আদর্শিক শূন্যতা সৃষ্টি করছে। সৃষ্টি করেছে নৈতিক দুর্বলতা, জন্ম নিয়েছে পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষিতদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা ও রুচিবিকৃতি। আজকের সমাজে পকেটমার, সিঁদকাটা চোর, ছিঁচকে চোর, আর গরু চোরের সংখ্যা কমে গেছে। তবে লাগামহীনভাবে বেড়েছে সুটকোট পরা চোর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে ফাইল আটকানো ‘চোর’, বালিশ উঠানো প্রকল্পের ‘ডাকাত’ এবং উচ্চশিক্ষিত ডিগ্রিধারী ‘কসাই’রা আজ দাপটের সাথে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর একটাই কারণ; তারা পাস করে ডিগ্রি পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষালাভ করেনি, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এরা জানেই না, হৃদয়ে ধারণ করা তো বহু দূরের কথা।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই আজ দুনিয়ার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আকাক্সক্ষার বিষয় হওয়া উচিত। শিক্ষাব্যবস্থার সব পর্যায়ে ধর্মীয় রীতি শিক্ষা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এ শিক্ষালাভের ফলে শিক্ষার্থীদের মন-মগজ, চরিত্র এমনভাবে গড়ে উঠবে যাতে ইসলামের আদর্শে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় বিধান মেনে জাগতিক সব জ্ঞানের আধার হবে একেকজন শিক্ষার্থী; তৈরি হবে মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিচারক, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রদূত প্রমুখ। এ শিক্ষা অর্জন করার মাধ্যমে একজন ইঞ্জিনিয়ারেরও ইমামতি করার যোগ্যতা অর্জিত হবে। একেকজন ডাক্তার হবেন ‘দায়ী ইলাল্লাহ’। তারা একই সাথে দ্বীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবেন। পার্থিব জীবনের শিক্ষার সব দিক ইসলামের দৃষ্টিতে গবেষণা করতে সক্ষম হবেন তারা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামের সাথে মানুষের আবিষ্কৃত, মানব রচিত বিধানের তুলনার মাধ্যমে ইসলামে যৌক্তিকতা বুঝতে পারবেন। ইসলামের বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর শিক্ষার্থীর সরল জীবনযাপন ও মেহনত নিজের লক্ষ্যে দৃঢ় থাকা ও আল্লাহর সৃষ্টির সেবায় অভ্যস্ত হবেন। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা ও জ্ঞানকে আল্লাহর আমানত ও রহমত হিসেবে গণ্য করতে শিখলে তারা তাদের ইলম অনুযায়ী আমল করবেন এবং সত্যিকারের জ্ঞানের প্রসার ঘটবে।
সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন চাই : শিক্ষার সব স্তরে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা; ধর্মীয় শিক্ষা বিষয়টি শুধু মুখস্ত বিদ্যানির্ভর লিখিত পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে লিখিতের পাশাপাশি ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষারও ব্যবস্থা করা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক লেভেলে আরবি, কুরআন, হাদিস, আকাইদ ইত্যাদি বিষয়কেও স্বল্প পরিসরে হলেও শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা। প্রচলিত ভিন্ন বিষয়গুলোর সাথে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিও সংযুক্ত করা, যেমন- ইতিহাসের সাথে ইসলামের ইতিহাস; অর্থনীতির সাথে ইসলামী অর্থনীতি পদার্থ ও রসায়নের বিভিন্ন বিজ্ঞানীর অবদানের মধ্যে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানও স্বীকার করা, যেমন- ভূগোলে আল খাওয়ারিজমি, ইবনে খুরদাদবিহ, আল বিরুনি, ইবনে খালদুন, ইবনে ইয়াকুবসহ বিখ্যাত মুসলিম ভূগোলবিদদের অবদান সম্পর্কে অবগত করা। উচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা যেন ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই ব্যবস্থা করা।
মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন : মাদরাসার শিক্ষার্থীদের এমনভাবে উভয়মুখী শিক্ষা দিতে হবে, যা তাদের একদিকে জোগাবে বলিষ্ঠ ঈমানী ভিত্তি; অন্য দিকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোকে ইসলামী জীবনাদর্শের মানদণ্ডে যাচাই করে এক বলিষ্ঠ ও উন্নত মুসলিম জীবন ক্ষেত্র নির্মাণে সক্ষম করে তুলবে।
মাদরাসার শিক্ষার্থীদের দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দ্বীনকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। দ্বীন ইসলামের শিক্ষাকে তাদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যেন মাদরাসা শিক্ষা থেকে বের হওয়ার পর তারা প্রচলিত বিভ্রান্তির গড্ডলিকা প্রবাহে দিকহারা হয়ে না পড়ে।
মাদরাসার শিক্ষার্থীদের দ্বীনী ইলম অর্জন ও ধারণের পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষায় অগ্রসর এবং কর্মজীবনে সব ক্ষেত্রে পারদর্শী করে তুলতে হবে। ইসলামকে ধারণকারী একজন ডাক্তার একজন নারী রোগীর পর্দা রক্ষার হাতিয়ার হবেন; একজন মুসলিম বিজ্ঞানী তার কর্মক্ষেত্রে কুরআনে বর্ণিত বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করবেন; একজন প্রকৃত মুসলিম অর্থনীতিবিদ সুদের ধ্বংসাত্মক দিক সবার সামনে তুলে ধরবেন; একজন প্রকৃত মুসলিম সাহিত্যিক তার রচনার দেশপ্রেম ও ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবেন ইত্যাদি।
শিক্ষাব্যবস্থাকে হতে হবে জীবনমুখী। শিক্ষিত জাতি শুধু সার্টিফিকেটধারী হবে না, বরং তারা শিক্ষার আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করবে। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা শুধু পরীক্ষায় ভালো করবে না বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। ডিগ্রিধারী অফিসার বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে শুধু জীবন চালানোর সংগ্রাম করবে না; বরং তাদের সংগ্রাম করতে হবে নিজেদের শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র দেশ ও জাতির উন্নতি সাধনের, শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ও নৈতিক শিক্ষার অমূল্য সাজে সজ্জিত করতে পারলেই তৈরি হবে আলোয় উদ্ভাসিত, সৎ ও যোগ্য প্রজন্ম যাদের জ্ঞান কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক মাধুর্য ও নৈতিকতার সুঘ্রাণে সুবাসিত হবে গোটা সমাজ ও দেশ; যাদের যোগ্য নেতৃত্বের প্রখর রশ্মিতে আলোকিত হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবী; যাদের দেশপ্রেমের দ্বারা পৃথিবীর বুকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ হবে আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
লেখক : উপাধ্যক্ষ, রোকনউদ্দিন মোল্লা গার্লস ডিগ্রি কলেজ,
আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ
Leave a Reply