বছর দশেকের সোহাগ। পলাশীর ফুটপাতেই কাটে তার সারাদিন। কাঁচাবাজার ও আশপাশের এলাকায় কুড়িয়ে পাওয়া খাবার খেয়েই এক রকম বেঁচে থাকা। কখনোসখনো বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও খাবার কিনে খাওয়ান তাকে। তবে এবার সেটাও জুটছে না। বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কোনো শিক্ষার্থী নেই ক্যাম্পাসে। পলাশীকেন্দ্র্রিক জমজমাট আড্ডাও নেই। এতে বেশ বিপাকেই পড়েছে সোহাগ। খাবারের সন্ধানে তাকে ছুটতে হচ্ছে দূর-দূরান্তে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে
ফুটপাতে মায়ের সঙ্গে শুয়ে থাকা সোহাগের কাছে জানতে চাওয়া হয়- ঈদ কবে? হা করে তাকিয়ে থাকা শিশুটির চাহনি-ই বলে দেয়, তার কাছে ঈদের আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। প্রতিদিন দু-তিনবেলা খাবার জোগানোটাই এসব সোহাগের কাছে মূল যুদ্ধ।
বছর ঘুরে ঈদ আসে। তবে সমাজের ছিন্নমূল মানুষগুলোর কাছে ঈদের দিনও অন্যদিনের মতোই সাধারণ একটা দিন। খুশির জোয়ারে সবাই ভাসলেও ঈদে কোনো বিশেষ আনন্দই স্পর্শ করে না ওদের। ভালো একটু খাবার জুটলেই রাজ্যের সুখ। এদের মধ্যে অনেকেই থাকে বস্তিতে, কেউ কেউ ফুটপাতের ওপরই রাত কাটায়। অনেকেই আবার জন্ম-পরিচয়হীন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রাজধানীর বিভিন্ন পার্ক ও মাঠের আশপাশেই ভবঘুরে হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়।
কারওয়ানবাজারের পেট্রোবাংলার সামনের ফুটপাতে কথা হয় অশীতিপর এক ব্যক্তির সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একসময় জীবনে ঈদ ছিল। কিন্তু সবাইকে হারিয়ে যখন ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছি, এর পর থেকে ঈদও হারিয়ে গেছে। তবুও ঈদের অপেক্ষায় থাকি। ভালো খাবার পাওয়া যায়। বছরের দুটা ঈদেই মানুষ ভালো খাবার দিয়ে যায়।’ বৃদ্ধা বলেন, ‘টাঙ্গাইলে গ্রামের বাড়ি। স্বামী ও ছেলেমেয়ে কেউ বাইছা নেই। বিয়ের পর অল্প বয়সেই জামাই মইরা গেছে। নিজেরে আমানত রাখছি, জামাইর লগে ওয়াদা করছি তাই আর বিয়া বসি নাই। বাবা বিয়ে দিতে চাইছে পালাইয়া চইলা আইছি। কিন্তু শরীরে এখন শক্তি নাই, তাই হাঁটতে পারি না। ভিক্ষাও কম পাই।’
হাইকোর্ট মাজারের সামনে সারাবছরই থাকেন অনেক ছিন্নমূল মানুষ। এদের অন্য কোনো ঠিকানা নেই। সেখানে কথা হয় জাহানারা বেগম নামে এক বৃদ্ধার সঙ্গে, ‘স্বামী ছেলেমেয়ে কেউ নাই আমার। সারাদিন ভিক্ষা কইরা যা পাই, তা খাইয়াই পড়ি থাহি। ঈদের দিন বলতে আলাদা কিছুই না আমার কাছে।’
আট বছরের রুবেলের মা মারা গেছে বছর তিনেক আগে। এর পর বাবা আরেকটি বিয়ে করে। সেই সংসারে আর জায়গা হয়নি রুবেলের। আশ্রয় নেয় হাইকোর্ট মাজারের সামনেই। দোয়েল চত্বর ও শাহবাগ থেকে ফুল কিনে বিক্রি করে মানুষের কাছে। এতে দৈনিক শ-দেড়শ টাকা আয় হয়। একাকী রুবেলের ভালোই চলে যায়। তবে বিশেষ দিনগুলোয় ওর কষ্ট হয়। ঈদের দিন ইচ্ছে হয় নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরতে যেতে। কিন্তু সেদিন আর নেই, সব অতীত।’ ছোট্ট রুবেল বলে, ‘মা বেঁচে থাকলে সব কিছুই ঠিক থাকত। এখন তো কেউ আর নেই আমার। তাই ঈদ বলতে আমারও কিছু নেই। অন্যদিনের মতোই ঘুরেফিরে কাটাই। বিকালে ফুল বিক্রি করি।’
সময়ের গতি থাকলেও এক জায়গাতেই যেন থেমে ছিন্নমূলের ‘ভাগ্যচক্র’। কারও বাবা-মা থেকেও নেই। আবার কেউ কেউ জানেই না, কার মাধ্যমে পৃথিবীর আলো দেখেছে সে। কে তাদের বাবা-মা। নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, পথই ওদের সব। দিনভর ঘুরে বেড়ায়, রাত নামলে পথেই ঘুমায় ওরা। তাদের কাছে ঈদ যেন এক দূরে থাকা চাঁদ। প্রশ্ন করলে বলে তারা- ‘ঈদ আমাগো আসেটা কই;/রোজই রাখি রোজা!/আমার কাছে ফরজ আগে,/ক্ষুধার খাওন খোঁজা!’ (এই অংশটি কবি মোহাম্মদ ইয়াছির আরাফাতের ‘ছিন্নমূলের ঈদ’ কবিতা থেকে নেওয়া)।
Leave a Reply