সারাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও। এ অবস্থায় রোগীর চাপ সামলানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোর জন্য। তৈরি হয়েছে মারাত্মক শয্যা সঙ্কট। ফলে যথা সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারাও যাচ্ছেন অনেক রোগী।
এমনই একজন রাজধানীর উত্তরখানের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৫৫)। গত ২ এপ্রিল থেকে তাকে নিয়ে একে একে পাঁচটি হাসপাতালে গিয়েছেন ছেলে রায়হান। গুরুতর অসুস্থ মনোয়ারার অক্সিজেন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো হাসপাতালই প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন দিতে পারেনি। অবশেষে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান তিনি।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন অনেকেই। দেশের কোনো হাসপাতালেই এখন আইসিইউ শয্যা খালি নেই। সাবেক সংসদ সদস্য ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী কবরী সারওয়ারও আইসিইউ পাননি। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাকে শেখ রাসেল গ্যাস্টোলিভার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল নাজমুল হক বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৮০০ বেড করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন এর একটিও খালি নেই। প্রতিদিনই রোগীর চাপ বাড়ছে। এর মধ্যে যে রোগীদের অক্সিজেন দরকার শুধু তাদেরই ভর্তি করা হচ্ছে। অন্যদের ভর্তি করার কোনো সুযোগ নেই। আইসিইউ তো একেবারেই খালি নেই।’
সামনের দিনে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন জানতে চাইলে নাজমুল হক বলেন, ‘এখানে বেড বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বেড বাড়ানো হলে এখন যেসব রোগী আছে তাদের চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটবে। ফলে সুস্থ্য হয়ে কেউ গেলেই শুধু বেড খালি হচ্ছে।’
এ দিকে প্রতিদিনই করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শনিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ৫ হাজার ৩৪৩ জন। এক দিনে এত মৃত্যু মহামারী শুরুর পর আর হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। গত ২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্ত মোট ৩৪৪ জনের মৃত্যু হয়। আর ৪ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ, এই ৭ দিনে মারা গেছেন ৪৪৮ জন।
এমন অবস্থার বিপরীতে হাসপাতালগুলোতে চলছে সঙ্কট। ঢাকার বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে শয্যা মারাত্মক সঙ্কটের বিষয়টি জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা: শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আজকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে একটি বেডও খালি হয়নি। ফলে নতুন রোগী ভর্তি করা যায়নি। তবে আমরা ১০০ বেড আর ১০টি আইসিইউ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে একটি বেড বা আইসিইউও খালি নেই।’
শুধু বেড বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এভাবে সম্ভব হবে না। আমরা তো বলছি, এখনই কঠোর লকডাউন দিয়ে মানুষের চলাচল সীমিত করতে হবে। পাশাপাশি কোনো পরিবারে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে আইসোলেশনে পাঠাতে হবে।’
একই পরিস্থিতি কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালেরও। এ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শিহাব উদ্দিন জানান, তার হাসপাতালে গত সপ্তাহের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০ শতাংশ। যত সময় যাচ্ছে, রোগী তত বাড়ছে। কোনো রোগী ছাড় পাওয়ার পরপরই সেখানে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আইসিইউ পূর্ণ। এখন যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের অধিকাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন। ফলে সবাইকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
এখনই হাসপাতালগুলো সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, রোগী যেভাবে বাড়ছে তাতে সামনের দিনগুলোতে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে? জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা: নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখনই বেড পাচ্ছে না, ভবিষ্যতেও পাবে না। এখন তিনজন পাচ্ছে না, ভবিষ্যতে ১৩ জন পাবে না। এই তো? আমরা বারবার বলছি, ১৫ বা ২১ দিনের লকডাউন প্রয়োজন। মানুষের মুভমেন্ট সীমিত করতে হবে। কিন্তু সরকার সাত দিনের লকডাউন দিল, এখন বলছে, আরো সাত দিনের কঠোর লকডাউন দেয়া হবে। কঠোর লকডাউনটা অবার কী? সাত দিনে আপনি কীভাবে বুঝবেন পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি-না? ফলে এখন যা হচ্ছে, তাতে আমার মনে হচ্ছে না যে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। সামনের দিনে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে।’
একই কথা বলছিলেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা: মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘আইসিইউ সেট-আপ করতে হয়ত সময় লাগে, কেননা এতে জনবল লাগে। কিন্তু হাই-ফ্লো অক্সিজেনের সাপ্লাইটা আমাদের বাড়াতে হবে। সেটার সক্ষমতা আমাদের আছে। দ্রুত এটা করতে হবে। অনেক রোগীকে শুধু অক্সিজেন দিয়েই সুস্থ করে তোলা সম্ভব।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে
Leave a Reply