এক বা দুই কক্ষবিশিষ্ট। সাইনবোর্ডসর্বস্ব। অথবা ইন্টারনেটে ডিগ্রি। পিএইচডি সনদ বিক্রির জন্য রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে গড়ে ওঠা বিদেশি ইউনিভার্সিটির ‘শাখা’, ‘ক্যাম্পাস’ সরকার অবৈধ ঘোষণা করেছিল। এসব বন্ধেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পর বিধিমালা করে এসব বৈধভাবে স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও নামে-বেনামে চলছে ভুয়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার।
সম্প্রতি অস্তিত্বহীন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ‘আমেরিকান ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসএ’-এর নামে রাজধানীতে ভুয়া স্টাডি সেন্টারের খোঁজ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কমিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময়কে বলেন, অস্তিত্বহীন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া স্টাডি সেন্টার বন্ধের পদক্ষেপের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আমরা চিঠি দিচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘আমেরিকান ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি’ নামে যে বিশ্ববিদ্যালয়টির কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বহীন বিশ্বদ্যিালয়টির নামে একটি ওয়েববসাইট খোলা হয়েছে এবং শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। ইউজিসি যাচাই করে দেখেছে, ভুয়া এই স্টাডি সেন্টারে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি দেখভাল করছে লিংকনস হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নামের দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর শাহজালাল টাওয়ারে এ জন্য একটি অফিস খোলা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি ব্যাচেলর, মাস্টার্স, এমপিএইচ, এমবিএ, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে স্পেশাল স্কলারশিপ এবং ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুবিধার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য পাঁচ হাজার ১০০ এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য ১০ হাজার ৬০০ ডলার নিচ্ছে।
এ বিষয়ে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, আমেরিকান ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএর ওয়েবসাইটটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় এটি ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নওগাঁ থেকে খোলা হয়েছে। ওয়েবসাইটে ব্যবহৃত একটি ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার ইত্যাদিতে শিক্ষার্থী ভর্তি বা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্পূর্ণ বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের সতর্ক থাকতে হবে। সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি সনদের বৈধতা দেবে না।
সম্প্রতি সৈয়দপুরে অস্তিত্বহীন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সতর্কবার্তা জারি করে ইউজিসি। কমিশনের দ্রুত পদক্ষেপে অস্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
বিভিন্ন সময়ে ভুয়া পিএইচডি দেওয়ায় বেশ কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া শাখা কালো তালিকাভুক্ত করেছে ইউজিসি। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ইউনিভার্সিটি (আইসিইউ), মালয়েশিয়ার পার্দানা ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব হনুলুলু, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি মেলবোর্ন, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল), দ্য সেন্ট্রাল বোর্ড অব হায়ার এডুকেশন (সিবিএইচই), ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া এবং আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি। নামে-বেনামে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার খুলে বিক্রি হচ্ছে পিএইচডি সনদ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এসব ডিগ্রির সত্যতা যাচাইয়ে বেরিয়ে আসছে এ ধরনের অবৈধ প্রতিষ্ঠানের নাম।
জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপপরিচালক আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ক্যাম্পাস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। তিনি এই ডিগ্রির মাধ্যমে চাকরিতে ইনক্রিমেন্টও পান। কিন্তু ২০১৭ সালে ইউজিসির এক তদন্তে ধরা পড়ে তার ডিগ্রি ভুয়া। ফলে ডিগ্রি বাতিল, ইনক্রিমেন্ট বাবদ প্রদত্ত অর্থ ফেরত এবং নৈতিক স্খলনের বিষয়ে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থার সুপারিশ করে ইউজিসি। একই প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বিপাকে পড়েন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখার খোলার জন্য সরকার ‘ক্রস বর্ডার হায়ার এডুকেশন (সিবিএইচই)-২০১৪’ নামে একটি নীতিমালা করেছে। এ অনুযায়ী, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যম্পাস স্থাপনের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর এলাকা থাকতে হবে। স্টাডি সেন্টারের ক্ষেত্রে ১০ হাজার বর্গফুটের ফ্লোর থাকতে হবে। নিজস্ব লাইব্রেরি থাকতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন যে কোনো তফসিলি ব্যাংকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জন্য পাঁচ কোটি এবং স্টাডি সেন্টারের জন্য এক কোটি টাকা স্থায়ী আমানত রাখতে হবে।
Leave a Reply