বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। খবরটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের। গত-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ জাতিসঙ্ঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করেছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচকের মানদণ্ডে জাতিসঙ্ঘ কোনো দেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে মাথাপিছু আয় হতে হয় এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৮২৭ ডলার। উন্নয়নশীল হতে হলে মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্ট দরকার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ৭৫.৩ পয়েন্ট অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে এলডিসি এবং ৩২-এ এলে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট ২৫ দশমিক ২। অর্থাৎ বাংলাদেশ ওই তিন সূচকেই কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর বৈশ্বিক সঙ্কটের মাঝেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা, মানবসম্পদ ও মাথাপিছু আয় সূচকে বাংলাদেশ তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করেছে। তবে সার্বিকভাবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ও বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে বলা যায়, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন সূচকে আমাদের অগ্রগতি হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেমন- মানুষের জীবনযাত্রার মান, বেকারত্ব, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব উৎপাদনের কাঁচামালের সহজলভ্যতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে নানা ঘাটতি রয়েছে। অর্থনৈতিক ভিত আরো মজবুত করার জন্য বাংলাদেশ সিডিপির কাছে সময় চেয়েছে, সিডিপি তা মূল্যায়ন করে আরো দুই বছর বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল তার মানে আমাদের হাতে আরো পাঁচ বছর সময় আছে। এই সময়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিলে, টেকসই রূপরেখা গ্রহণ করে বাস্তবায়নে সরকারসহ বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করলে অর্থনীতির ভিত টেকসই হওয়া অসম্ভব নয়।
জাতিসঙ্ঘের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের ৪৭টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এই সব দেশে ৮৮ কোটি মানুষের বাস। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ এ তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে সব দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছে। এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে বের হওয়ার সুপারিশ আমাদের জন্য নিঃসন্দেহ বড় অর্জন। তবে এর ফলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হলে এলডিসি হিসেবে যেসব বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশ পায় তা আর পাবে না। যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধা হারাবে, ওষুধ শিল্পের মেধাস্বত্বে¡র আন্তর্জাতিক আইন কানুনে অব্যাহতিও থাকবে না, কৃষিতে ভর্র্তুকি সুবিধা কমাতে হবে। ঋণের সুদের হার বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে উন্নয়শীল দেশ হলে আমরা বেশ কিছু সুবিধা পাবো। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা জোটগুলোতে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, ভাবমর্যাদা ভালো হওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুবিধা হবে। দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করা হবে। উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা মূল্যায়ন পাবো, দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে, বড় বাজার সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। করোনা মহামারীর মাঝেও আমাদের অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় আবদান রয়েছে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের আয় ও আমাদের কৃষি। এ ছাড়া পোশাক শিল্প আমাদের রফতানি বাণিজ্যে বড় অবদান রেখে যাচ্ছে। তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশের উত্তরণে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৩ শতাংশ প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় তা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে জিএসপি প্লাস মানদণ্ডে ইউরোপিয়ান কমিশনের সাথে আলোচনা শুরু করা উচিত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) রূপরেখাকে এলএডিসি থেকে উত্তরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের উৎপাদনশীলতায় সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। সরকার এ বছর (২০২১-২৫) যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাকেও এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল হিসেবে জোরালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে পরিবহন, বন্দর ও আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি জোর দেয়া যেতে পারে। বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যচুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। দেশীয় শিল্পে উন্নয়ন ও বিকাশ লাভের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো ও কার্যকরি কৌশল গ্রহণ করা উচিত। সিএমএসএমই বিনিয়োগ বাড়ানো ও এ খাতের কাঠামোভাবে উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। চীন, জাপান, ভারতসহ অন্যান্য দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করা উচিত। আমাদের রফতানি ক্ষেত্রে শুধু গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নির্ভর না হয়ে নতুন নতুন পণ্য রফতানি, রফতানিমুখী পণ্যগুলোর উৎপাদন ও গুণগতমান উন্নয়নের প্রতি জোর দেয়া উচিত। আমাদের ওষুধ শিল্পের কাঁচামালে আমদানিনির্ভরশীলতা কিভাবে কমানো যায় সেদিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত।
আমাদের পাটশিল্প, চামড়াশিল্পসহ চিংড়ি উৎপাদন, কৃষিপণ্যকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিশ্ববাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার বিষয়টি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো সমস্যা এখনো প্রকট। জ্বালানি ও অবকাঠামোগত ঘাটতি দূর করা উচিত। একটি দেশের শুধু জিডিপি দেখেই সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা যায় না। জিডিপি বেশি হলেও টেকসই উন্নয়ন দুর্বল হতে পারে। মাথাপিছু আয় বেশি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমান নি¤œ হতে পারে। যে সমাজে বৈষম্য বেশি থাকে সেখানে এসব সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটা অস্বীকার করার জো নেই। বৈষম্য বেশি হলে গড় আয়ের হিসাব বরং বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। তাই ভারসাম্য ও কল্যাণমুখী অর্থনীতির জন্য বৈষম্য অবশ্যই কমাতে হবে। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে প্রকল্পগুলোর ব্যয় বাড়ে। সুশাসনের অভাব, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে দুর্নীতির জন্ম হয়। তাই টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত জীবনমানের জন্য এসব ক্ষেত্রে সংস্কারের বিকল্প নেই। বিগত ৫০ বছরের বাংলাদেশকে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। বিশ্বের বেশ কিছু তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসনীয়। আমাদের কৃষক, শ্রমিক এমনকি প্রবাসী শ্রমিকরাও অনেক পরিশ্রমী। অথচ শ্রমজীবী মানুষের আয় ও জীবনের নিরাপত্তা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত। উন্নয়নের প্রচারণায় আমরা তাদের কথা ভুলে যাই। এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো উন্নয়নশীল দেশের সাথে রফতানি প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা ধরে রাখা। বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে রফতানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট দুই হাজার ৫৮৬ কোটি ডলার পণ্য রফতানি হয়েছে। গত অর্থবছরে একই সময় যা ছিল দুই হাজার ৬২৪ কোটি ডলার। রফতানি কমেছে ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট মাসে তৈরী পোশাক রফতানিতেও আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮২ কোটি কমে দুই হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নেমেছে। আমাদের রফতানি বহুমুখীকরণের পথে বাধাগুলো দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। ব্যক্তি খাতের রফতানি শিল্পে বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply