গণতন্ত্রের জন্য অশুভ বার্তা দিচ্ছে অনাস্থার নির্বাচন। সদ্য সমাপ্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের প্রতি নাগরিকদের অনাগ্রহের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের পর থেকেই ভোটের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে মানুষের। তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিশ্লেষণে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি ভোটার কেন্দ্রে না যাওয়া মূলত গণতন্ত্রের জন্য একটি অশুভ বার্তা। গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পৃথকভাবে সাংবাদিকদের কাছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
এ দিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ঢাকার সচেতন নাগরিকদের মধ্যেও ভোটের প্রতি আগ্রহ কমছে। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেখানে ভোট পড়েছিল ৩৭ শতাংশ সেখানে এবার ভোট পড়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। অন্য দিকে ২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেখানে ভোট পড়েছিল ৪৮ ভাগ সেখানে এবার পড়েছে ২৯ ভাগ। অর্থাৎ ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে এবার ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ ভোটার কেন্দ্রমুখীই হননি।
নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের এই অনাগ্রহের চিত্র শুধু ঢাকা শহরেই নয়, ঢাকার বাইরের সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা কিংবা উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনেও প্রায় একই ধরনের। ইসি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে দেশের বিভিন্ন পৌরসভা নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ৭৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি কমে দাঁড়ায় ৫৭ থেকে ৭৮ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বেশ কিছু উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩৭ থেকে ৪৩ শতাংশ। ভোটের রাজনীতিতে মানুষের এই অনীহা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতি অনেক বেশি জনসমর্থন রয়েছে। সেই বিবেচনায় এবারের সিটি নির্বাচনে আরো বেশি ভোট পড়বে এটাই আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু এত ভালো একটা নির্বাচন হওয়ার পরেও ভোট কেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতির যে হার এটা আমাদের গণতন্ত্রের জন্যই অশনিসঙ্কেত বলেই আমি মনে করি।
ইসি সূত্র জানায়, এবার সিটি নির্বাচনে ভোটের হার উত্তরে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রার্থীকে। ভোটের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে।
নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি একধরনের অনাগ্রহ সৃষ্টি হতে থাকে। বিভিন্ন নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও জবরদখলের ঘটনায় নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফল নির্ধারণে ভোটারদের গুরুত্ব নেই, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণে ভোটারের বড় অংশের মধ্যে ভোটবিমুখতা সৃষ্টি হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের ফল বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে যেখানে ভোটার ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। ভোট দিয়েছেন ৭ লাখ ৬২ হাজার ১৮৮ জন। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম চার লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়ে মেয়র হয়েছেন। অবশ্য তিনি প্রদত্ত ভোটের ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ পেয়েছেন।
এবার ঢাকা দক্ষিণে ভোটার ছিল ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ জন। ভোট পড়েছে সাত লাখ ১৩ হাজার ৫০টি। ৭১ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। চার লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি নির্বাচনী এলাকার মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়েছেন। তবে তিনি প্রদত্ত ভোটের ৫৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ পেয়েছেন।
অন্য দিকে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে অস্বাভাবিক কম ভোট পড়া গণতন্ত্রের জন্য শুভকর নয় বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গতকাল নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে অস্বাভাবিক কম ভোট পড়া স্বাভাবিক মনে করলেও এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত হতে পারে। জনগণ এখন নির্বাচন বা ভোটের প্রতি নিরাসক্ত। তাই নানা প্রকার ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা দিয়ে এই বাস্তব অবস্থার চিত্র খণ্ডন করা যাবে না। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। সদ্য সমাপ্ত এই নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণের অনীহা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, জাতি কি ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
এ দিকে নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ এবং প্রতিক্রিয়ায় দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কিংবা কোনো সঙ্কট তৈরি হবে কি না এসব বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন তার বিশ্লেষণে বলেছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা, ভোট গ্রহণে অব্যবস্থাপনা, দৃশ্যমান অভিযোগের পরেও ইসির নিষ্ক্রিয়তায় নির্বাচন বা ভোটের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে তাদের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের দিকে চলে যাবে। আর এটা কারো জন্যই কাক্সিক্ষত হতে পারে না।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম এবং ভোটে ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের পরদিনই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহ এটা কার্যকর গণতন্ত্রের জন্যই বড় একটি হুমকি। যদিও প্রকৃত অর্থে দেশে গণতান্ত্রিক কোনো পরিবেশ নেই। এবার নির্বাচনে ভোটাররাই এটা স্পষ্টভাবে আবারো প্রমাণ করেছে। অর্থাৎ সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাষ্ট্র্রযন্ত্রের মধ্যে এখন আর কোনো পার্থক্য নেই। দেশ এখন পুরোপুরি একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে।
Leave a Reply