দুর্নীতির সর্বনাশা থাবায় আক্রান্ত এবার দেশের আকাশও। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহারকারী নন-শিডিউল ফ্লাইটের চার্জ নেওয়ার জন্য বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চুক্তির মাধ্যমে। ওই প্রতিষ্ঠানটি একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে এ চার্জ গ্রহণ করে থাকে। ¯্রফে তাদের এ সফটওয়্যার ব্যবহারের কারণেই গৃহীত চার্জের ৮৫ শতাংশ চলে যায় প্রতিষ্ঠানটির পকেটে। এতে করে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মনে করছে, এ চুক্তির মাধ্যমে তৃতীয় একটি পক্ষ নেপথ্য থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য, এ ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় বা বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া হয়নি। ঠিকাদার নিয়োগের আগে অনুমোদন নেওয়া হয়নি বোর্ডেরও।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ও মনে করে, বিদ্যমান পন্থায় অপারেটর নিয়োগের চুক্তিটি বিধিবহির্ভূত, অযৌক্তিক ও দুরভিসন্ধিমূলক। সফটওয়্যার ব্যবহারে নিজেদেরই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাই চুক্তি বাতিল ও নিজস্ব সফটওয়্যারের ব্যবস্থা করতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এ ধরনের ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হতো এয়ারলাইন্সকে। বর্তমানে ওভারফ্লাইংয়ে অটোমেটেড পদ্ধতিতে অনুমতি প্রদান করা হয় যাকে পারমিট অপারেশন ডেটাবেজ (পিওডি) বলা হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা থাকায় দুর্নীতি করার মতো অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। বর্তমানে চুক্তিকৃত প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যারের মাধ্যমে নন-শিডিউল ফ্লাইট অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়। বেবিচক সূত্রের তথ্যমতে, এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রতিটি নন-শিডিউল ফ্লাইট অবতরণে অতিরিক্ত ১৯৫ ডলার দিতে হয়। এর ১৫ শতাংশ
অর্থ পায় বেবিচক। ওই অপারেটরের কাজটি হচ্ছে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার যেটি নিজেরা কিনে পরিচালনা করতে পারে বেবিচক। সে ক্ষেত্রে শতভাগ অর্থ রাজস্ব খাতে জমা হবে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সংস্থার কাছ থেকে এ অর্থের সিংহভাগ কোন যুক্তিতে অপারেটরকে দেওয়া হচ্ছেÑ তা জানতে তদন্ত করে দুদক।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী আমাদের সময়কে বলেছেন, ওভার ফ্লাইং চার্জের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটছে। সফটওয়্যার ব্যবহারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটি করা হচ্ছে। এটি আগের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা। আমরা বরং এর পরিবর্তন আনছি। রিফর্ম করছি। বলেছি, নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে এ কাজটি করতে সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে। যাতে এই চার্জের কোনো পয়সা অন্য কেউ না পায়। এ কাজটির মাধ্যমে কেউ হয়তো বেনিফিশিয়ারি হতো। আমরা পরিবর্তন আনছি। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, নন-শিডিউল ফ্লাইট অনুমতির ক্ষেত্রে অপারেটর নিয়োগের চুক্তিটি পর্যালোচনা করতে নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। আর নিজস্ব সফটওয়্যার কেনা এবং চুক্তি বাতিলের কোনো নির্দেশনা দিয়ে থাকলে বিষয়টি এখনো জানা নেই।
বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অপারেটর নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আর্থিক প্রস্তাবকালে প্রতি বছর ৭২৫০টি নন-শিডিউল ফ্লাইটের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি বছর বেবিচকের আয় হতো অন্তত ১২ কোটি ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ টাকা। নিজস্ব সফটওয়্যারের পরিবর্তে তৃতীয় পক্ষকে সুবিধা দিতে ৮৫ ভাগ অর্থের চুক্তির বিনিময়ে বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে অটোমেটেড পদ্ধতি চালু করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, সরকারি গেজেটে প্রকাশিত শিডিউল-৪ এর রেট অনুযায়ী এয়ারক্রাফটের ওজনের ভিত্তিতে ওভার ফ্লাই, ল্যান্ডিং ও রুট নেভিগেশন চার্জ আদায়ের কথা। ওভার ফ্লাইংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থা বেবিচকের কাছে আবেদন করলে তা যাচাই-বাছাই করে ফ্লাইট সেফটি বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়। পরে যাচাই-বাছাই শেষে তা ট্রাফিক কন্ট্রোল বিভাগকে অবহিত করার কথা। আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতি চালুকালে নন-শিডিউল ফ্লাইট কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োজিত ওএসপিএল (অপারেশনাল সার্ভিস প্রভাইডার লিমিটেড) লাইসেন্সধারীদের মাধ্যমে অনুমতি দেওয়া হতো। ওএসপিএল লাইসেন্সধারীরা নন-শিডিউল ফ্লাইটের পক্ষে বেবিচকের কাছে আবেদন করে অনুমতি পেত। তখন অনুমতির জন্য অর্থ না দিয়ে শুধু ওভার ফ্লাইংয়ের চার্জ পরিশোধ করত। ওএসপিএল লাইসেন্সধারীরা নন-শিডিউল ফ্লাইট কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের নিজস্ব সম্মানী আদায় করত। এখনো তারা সম্মানী পায় তাদের কাছ থেকে। ওই ম্যানুয়াল পদ্ধতি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। ফলে ওভারফ্লাইং চার্জ বকেয়া পড়ত। এ জন্যই অটোমেশন পদ্ধতিতে যায় বেবিচক। মূল কথা হচ্ছে, এ ধরনের সফটওয়্যার নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে কিনতে পারত সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। তা না করে এএসএল সিস্টেম লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সংস্থাটি। ৫ বছরের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করা হয় শতকরা ৮৫ ভাগ ফির বিনিময়ে। মেয়াদশেষে একই শর্তে একই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার পাঁয়তারা হতে পারে। কিন্তু কোন যোগ্যতা এবং কী কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাবে তার সদুত্তর নেই। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, আগে ওএসপিএল লাইসন্সেধারীর মাধ্যমে ফ্লাইটের অনুমতি চাওয়া হতো বেবিচকের কাছে। এখন সরাসরি সফটওয়্যার ঠিকাদারের কাছে আবেদন করে অনুমতি নিতে হচ্ছে। এতে করে বেবিচকের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া কতটি ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে তার তথ্য সমন্বয়েরও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার দাবি, যে সফটওয়্যারটি তারা এখন ব্যবহার করছেন সেটি নিউজিল্যান্ডের তৈরি। এটি অনেক উন্নত দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সফটওয়্যারে প্রতি মিনিটের আপডেট পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং আপডেট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না অভিযোগ সঠিক নয়।
সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক বিমান পরিচালনা নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পরিচালিত যে কোনো এয়ারলাইন্সের সিডিউল নন-শিডিউল ফ্লাইটের ওভার ফ্লাই, ল্যান্ডিং ও রিফুয়েলিংয়ের জন্য পারমিশন চার্জ দিতে হয়। এটি আদায়ের এখতিয়ার বেবিচকের। শিডিউল ফ্লাইটের জন্য ৬ মাসের জন্য একবারই অনুমতি দেওয়া হয়। আর নন-শিডিউল ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়া হয় কেস টু কেস ভিত্তিতে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, যে কোনো দেশের আকাশপথ ব্যবহার করলে এ ধরনের চার্জ দিতে হয়।
জানা গেছে, দুর্র্নীতি দমন কমিশন বেবিচকের নন-শিডিউল ফ্লাইটের ওভার ফ্লাইং অটোমেশনের কাজটি ‘এএসএল সিস্টেম’ নামের কোম্পানিকে কোন প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছে তা জানতে চায়। একই সঙ্গে শুরু থেকে কার্যাদেশ পাওয়া পর্যন্ত সব ধরনের প্রক্রিয়ার রেকর্ডপত্র তলব করা হয়। ওই কোম্পানির সঙ্গে প্রতি ফ্লাইওভারে সিভিল এভিয়েশনের কত টাকার চুক্তি হয়েছে, শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত এএসএল সিস্টেম থেকে সিভিল এভিয়েশন কত টাকা আয় করেছে, এ সংক্রান্ত পেমেন্ট স্ট্যাটাস, লেজার কপি প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহে নামে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালে ১০টি ওএসপিএল কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয় সিভিল এভিয়েশন। এরপর থেকে এই ১০টি কোম্পানিই বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে চার্জ আদায় ও তাদের জন্য ফ্লাইটের অনুমতি নিয়ে আসছিল। ২০১৬ সালে এএসএল সিস্টেম নামের একটি কোম্পানি ওএসপিএল কোম্পানি কার্যক্রম অটোমেশনের প্রস্তাব দেওয়া হয় বেবিচকের কাছে। পরে এএসএল সিস্টেমকে ওএসপিএল লাইসেন্স দিয়ে দেয় সংস্থাটি। এ নিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় মনে করে, অটোমেশনের সফটওয়্যার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কিনে স্থায়ীভাবে চার্জ আদায় করতে পারত বেবিচক। এ ক্ষেত্রে পরিচালনার জন্য সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট লোকবলকে প্রশিক্ষিত করলে তা স্থায়ীভাবে দেশের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হতো।
বেবিচক সূত্র জানায়, সিভিল এভিয়েশন অ্যাক্ট ২০১৭-এর ১০ ধারা অনুযায়ী যে কোনো পারমিটের আবেদন ও প্রদানের পদ্ধতি এএনও দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সব ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সরকারের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। সিভিল এভিয়েশন অ্যাক্ট ২০১৭-এর ১৭(২) এবং ১৮(১)-এর চ ধারা অনুযায়ী সব উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব তহবিলে জমা করার বিধান আছে। এখানে তার ব্যত্যয় ঘটেছে।
Leave a Reply