গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা, কার্যকর সংসদ গঠন ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। সরকার গঠনের পর এর কোনোটি কি পূরণ হয়েছে? এ নিয়ে নানা বক্তব্য ও আলোচনা আছে। তবুও সরকার তার টানা তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বছর পূর্তিতে উন্নয়ন ও অগ্রগামিতার জন্য প্রশংসিত হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতি দমন করতে না পারায় সমালোচনাও কম নয়। সরকারের উন্নয়ন কিছু ‘দুর্বৃত্ত’, ‘দুর্নীতিবাজের’ কারণে ঢাকা পড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কয়েকটি বাস্তবায়ন চলমান আছে। কোনো কোনোটি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। যেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সমাজে স্বস্তি আনতে পারে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কে জনমনে আস্থা তৈরি করতে পারে, সে রকম অনেক বিষয় প্রতিশ্রুতিতেই আটকা আছে। তবে সফলতা বিচার করতে গেলে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান করার বিষয়টি আলোচনায় আসছে বেশি। নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ যে কিছু করতে পারে, তা আওয়ামী লীগ সরকারের কল্যাণেই দেখল জাতি।
এ বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দুই বছর পূর্তি আজ। দুই বছর আগে এই দিনে মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন। গত দুই বছরে সরকার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ইস্যুতে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়ে গেছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, কার্যকর সংসদ গড়ে তোলা, দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মাদক নির্মূল, জনগণের ক্ষমতায়ন, অবকাঠামো উন্নয়নে বৃহৎ প্রকল্প, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, প্রতিরক্ষা : নিরাপত্তা সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা সুরক্ষা, গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করাসহ নির্বাচনী ইশতেহারে ৩৩টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
গত দুই বছরে এর কতটুকু বাস্তায়ন হয়েছে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এ সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারের ধারেকাছেও নেই। কারণ তারা তো জনগণের নির্বাচিত সরকার নয়। তারা ভোট ডাকাতি করেই ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের দিকে সরকারের সামান্যতম নজরও নেই। সরকার তার মূল কাজ বাদ দিয়ে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নেই সময় পার করছে। সাধারণ নাগরিকরা প্রতি মুহূর্তে গুম-খুনের ভয়ে আতঙ্কে থাকে। এখানে আইনের শাসন একেবারেই অনুপস্থিত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে দিয়েছে বর্তমান সরকার। রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গের সঙ্গে কোনো অঙ্গের সমন্বয় নেই। দেশে ৫০ টাকার খাজনা ২ হাজারে দিতে হচ্ছে। দুর্নীতি এখানে সবকিছুকেই গিলে খেয়েছে।
তিনি বলেন, বৈশি^ক মহামারী করোনা নিয়েও যথেষ্ট দুর্নীতি হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় সরকার সাধারণ মানুষকে খুবই নিরাশ করেছে। এখন আবার করোনার টিকা নিয়েও নয়ছয় শুরু হয়েছে। এই টিকা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তিনি আরও বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও রাজনীতিকরণ করেছে এই সরকার। ফলে তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। একটা স্বাধীন দেশে এ ব্যবস্থা চলতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় জনবিস্ফোরণ ঘটবেই। সুতরাং জনবিস্ফোরণের আগেই সরকারকে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে জনগণকে ভোটাধিকার দিতে হবে।
দুই বছরে সরকারের কর্মকা- খুবই ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ২০১৯, ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের হাত ধরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। দুই বছরে- সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাধা অতিক্রম করে মূল পদ্মা সেতুর এপার-ওপার সংযোগ সম্পন্নকরণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১-এর মাধ্যমে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের মতো এগিয়ে নিতে নেওয়া হয়েছে ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে সরকার। স্বল্প এই সময়ে এ কাজ বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য, যা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীতে অর্থনীতি চুপসে গেলেও রেমিট্যান্সে ছিল গতি; ২০১৯ সালের চেয়েও ২০২০ সালে ২০ শতাংশ বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ১৮ লাখ (২১.৭৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। ই-পাসপোর্ট সেবা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৯৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ৩০ শতাংশ সম্পন্ন। বৈশ্বিক সূচকে সাইবার নিরাপত্তায় আট ধাপ এগিয়ে ৬৫তম স্থানে বাংলাদেশ। ২১ জেলায় ডিজিটাল রেকর্ড রুম চালু করা হয়েছে। সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে কর্মসংস্থান হবে এক কোটি মানুষের। কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্প খাতে সহজে পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটের নির্দেশনা রয়েছে। ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে সরকার এক অনন্য স্তরে পৌঁছে যায় বলে মন্তব্য করেন আবদুর রহমান।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের মতে, দলীয় প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগ বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা যে ইশতেহার দিয়েছিলাম তার বেশিরভাগ বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বেকার সমস্যা কমেছে, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানো হচ্ছে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তো বলা যায় বিপ্লব ঘটে গেছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি সব দেশেই কমবেশি হয়, তবে আমাদের দেশে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না সরকার। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করছে। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে দল-মত বিবেচনা করা হচ্ছে না। আর সন্ত্রাস-জঙ্গি প্রতিরোধে সরকারের সফলতা তো সর্বমহলে প্রশংসিত।
Leave a Reply