বিদায় নিচ্ছে ২০২০ সাল। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত সবাই। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বছরটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মহামারির এ বছরে অনেকে প্রিয়জনকে হারিয়েছে। দেশের রাজনীতি, চলচ্চিত্র, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক কৃতীকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। নিজ নিজ অঙ্গনে যারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন-এর নবম চেয়ারম্যান ড. সা্থদত হুসাইন ২২শে এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
১লা জুলাই বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন দেশের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমান। ব্যবসায়ে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১২ সালে বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড পান। ৯ই জুলাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও আইনজীবী সাহারা খাতুন ইন্তেকাল করেন। যিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২রা জুন বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে ঢাকার গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৩ই জুলাই ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে শিল্পোদ্যোক্তা ও যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম বাবুল মৃত্যুবরণ করেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ ১৭ই জুলাই ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক, সাবেকমন্ত্রী ও চারবারের এমপি শাহজাহান সিরাজ ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৫ই আগস্ট চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মুর্তজা বশীর ইন্তিকাল করেন। তার পিতা ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মুর্তজা বশীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার (সাবেক অ্যাপোলো) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত আমীর আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী ইন্তেকাল করেন। তিনি একইসঙ্গে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামের, হাটহাজারীর মহাপরিচালক ছিলেন। ১০৩ বছর বয়সে শাহ্ আহমদ শফী বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। বাংলাদেশের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ২৪শে অক্টোবর মারা যান। ১৯৬০ সালে তিনি আইন পেশায় আসেন। ১৯৮৯-১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১/১১ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সঙ্কটময় মুহূর্তে তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার অভিযোগ আনা হয়। ওইসময় তিনি তাদের দু’জনের পরামর্শক ছিলেন। তার কর্মজীবনকালে হাজারো মামলায় অংশ নিয়েছেন। তাঁর প্রায় ৫০০টি মামলা আইন-সাহিত্যে প্রকাশিত হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৭শে সেপ্টেম্বর মার যান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি ২০০৯ সালের ১৩ই জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে হাইকোর্টে অনুশীলন শুরু করেন। ২০০৫-২০০৬ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। ২৪শে নভেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নূর হুসাইন কাসেমী ১৩ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তিনি আল হাইআতুল উলয়ার সহ-সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা ও জামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদ নগরের শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। ২৪শে ডিসেম্বর ভোর রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাসেম। বার্ধক্যজনিত জটিলতার পাশাপাশি তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। সাবেক মন্ত্রী ও পাঁচবারের সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে। গত ৯ই ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও সাহিত্যিক মনজুরে মওলা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০শে ডিসেম্বর মারা যান। ২৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত দেওয়ানবাগ দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা। তিনি দেওয়ানবাগী নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া বিদায় নেয়া রাজনীতিবিদ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন, ৯ম ও ১০ম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী, বরগুনা-২ আসনের এমপি সৈয়দ রহমাতুর রব ইরতিজা আহসান, ১০ম সংসদে বাগেরহাট-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি মোজাম্মেল হোসেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বগুড়া-১ আসনের এমপি আব্দুল মান্নান, যশোর-৩ আসনের এমপি ইসমত আরা সাদেক, গাজীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি রহমত আলী, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মাওলানা আবদুস সোবহান, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি এবং বিশ্ব বৌদ্ধ ভ্রাতৃত্ব সংঘের সহ-সভাপতি সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রংপুর জেলার রাজনীতিবিদ ও সাবেক এমপি রহিম উদ্দিন ভরসা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল, পাবনা-৪ আসনের এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, ঢাকা-৫ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা, জামালপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি এবং সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির তালুকদার, ঢাকা-৯ আসনের সাবেক এমপি ও শিল্পপতি মকবুল হোসেন, চাঁদপুর-৫ আসনের সাবেক এমপি এম এ মতিন, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিবিদ ও যশোর-২ আসনের সাবেক এমপি শাহাদৎ হুসাইন, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার রাজনীতিবিদ ও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি সুলতান উদ্দিন ভূঁইয়া, সাবেক এমপি ও মন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল গাফফার হালদার, টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামান, নওগাঁ-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম প্রমুখ।
বিনোদন জগতের অনেক গুণী শিল্পী বিদায় নিয়েছেন এ বছর। ১৬ই মে মারা যান সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী আজাদ রহমান। একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য সংগীতব্যক্তিত্ব আলাউদ্দীন আলী মারা যান গত ৯ই আগস্ট। ক্যান্সারে ভুগে এবং শেষ বেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিশিষ্ট অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক আলী যাকের। গত ২৭শে নভেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ বছরই ক্যান্সারে ভুগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘প্লে-ব্যাক সম্রাট’ এন্ড্রু কিশোর। গত ৬ই জুলাই সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় তার বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান নন্দিত অভিনেতা সাদেক বাচ্চু। ২৬শে ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জনপ্রিয় নাট্য অভিনেতা আবদুল কাদের। তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। পাশাপাশি করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ৯ই সেপ্টেম্বর মারা যান নাট্য ও মঞ্চ অভিনেতা কে এস ফিরোজ।
Leave a Reply