চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী শহর উহান থেকে প্রায় গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ভাইরাসটির বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অন্তত ৬৯টি দেশ চীনা নাগরিকদের ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এর মধ্যে অন্তত ৬০টি দেশ চীনা নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এ ছাড়া চারটি দেশ চীনা নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং চীনের উহান কিংবা ওই প্রদেশে সম্প্রতি ভ্রমণ করেছেন এমন যে কারো বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পাঁচটি দেশ।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার ঠেকাতে ৪৭টি দেশ চীনা নাগরিকদের দেশে প্রবেশের আগেই বিমানবন্দরে তাপমাত্রা পরিমাপ করা থেকে শুরু করে নানা রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলছে, যারা এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছেন তাদেরকে নিজ নিজ স্বাস্থ্যের অবস্থার ভিত্তিতে ভ্রমণের আয়োজন করতে। এ ছাড়া যে দেশে তারা যাচ্ছেন সেখানে ভ্রমণের বিষয়ে ওই দেশ কর্তৃক আরোপিত অভিবাসন-সংক্রান্ত নিয়মনীতি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এ দিকে গতকাল শনিবার চীনের স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া হিসাবে অনুযায়ী, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা আড়াই শ’ ছাড়িয়েছে। চীনের মূল ভূখণ্ডেই এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭৯১ জনের ওপরে। হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর থেকেই ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ দিকে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে চীন ভ্রমণে ও দেশে চীনফেরত ব্যক্তিদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বিভিন্ন দেশ। চীনে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। এমতাবস্থায় কার্যত পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চীন। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সম্প্রতি যেসব দেশ ও সংস্থা চীনে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে, তারা হলোÑ কানাডা, ফ্রান্স, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, তানজানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, হংকং, ডেল্টা এয়ারলাইন্স, মিসর ও ফিনল্যান্ড।
আরো যেসব দেশ ও বিমান সংস্থা চীনগামী ফ্লাইট স্থগিত ও বাতিল করেছে সেগুলো হলো- ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ার গ্রুপ, জার্মানির লুফথানসা, সুইডেনভিত্তিক সাস, তুর্কিশ এয়ারলাইন্স, শিকাগোভিত্তিক ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভার্জিন আটলান্টিক। এদের বেশির ভাগই ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত ও বাতিল কার্যকরের কথা বলেছে।
এ ছাড়া সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, যারা দীর্ঘ দিন ধরে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন বা যারা সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা, তারা বাদে কোনো চীনা পাসপোর্টধারীকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। তবে যেসব চীনা পাসপোর্টধারী দেখাতে পারবেন যে, তারা সম্প্রতি চীনে যাননি, তা হলে কেস-বাই-কেস বিবেচনায় তাদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশে অনুমতি দেয়া হতে পারে।
অন্য দিকে নতুন করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীন সম্পর্কে বৈরি মনোভাব বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় তা বাস্তবিক উদ্বেগের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জাপানে টুইটার ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে ‘চীনারা জাপানে এসো না’ হ্যাশট্যাগ। সিঙ্গাপুরে কয়েক হাজার মানুষ দেশটিতে চীনা নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে একটি আবেদন করেছেন সরকারের কাছে। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা একটি প্রতীক তুলে ধরছেন যাতে বলা হচ্ছে, চীনা ক্রেতাদের স্বাগত জানানো হবে না। ফ্রান্সে একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় ‘হলুদ সঙ্কেত’ প্রকাশ করে সতর্কতা জারি করেছে। কানাডার টরেন্টোর উপকূলে একটি জেলা স্কুলের অভিভাবকরা দাবি করেছেন, সম্প্রতি চীন থেকে ফেরা একটি পরিবারের শিশুদের ১৭ দিনের জন্য শ্রেণিকক্ষে আসতে না দেয়ার জন্য।
সুস্থ জীবনে ২০ জন
করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কের মধ্যে যেন আশার প্রদীপ জ্বালল চীনে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ২০ রোগীর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়ার ভিডিও ছেড়েছে তারা। করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে যে উহান থেকে, সেই মহাবিপদগ্রস্ত শহরেরই একটি হাসপাতালের এই ভিডিও যেন আতঙ্কিত বিশ্ববাসীর প্রাণসঞ্চার ঘটিয়েছে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত ১১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, করোনা ভাইরাস মহামারির কেন্দ্রস্থল হুবেই প্রদেশের শহর উহানের জিনজিনতান হাসপাতালের সামনে ২০ রোগী দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন এবং ‘বিজয়’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন।
ফ্লাইট ফেরাল মিয়ানমার, কড়াকড়ি সিঙ্গাপুরে
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ চীনের দক্ষিণাঞ্চল গুয়াংঝু থেকে আসা একটি ফ্লাইট প্রায় সব যাত্রীসহ ফিরিয়ে দিয়েছে। এ দিকে সিঙ্গাপুরও চীন থেকে আসা কাউকেই সে দেশে ঢুকতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শুক্রবার মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, চীনের ফ্লাইটটিতে একজন যাত্রীর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মতো ফ্লুয়ের লক্ষণ ধরা পড়ায় ফ্লাইটটিকে ফেরত পাঠানো হয়।
গুয়াংঝু থেকে আসা বিমান মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে পৌঁছলে অসুস্থ ওই চীনা যাত্রীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে আলাদা করে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন সরকারের মুখপাত্র জ হাতয়। ওই ফ্লাইটে আসা আরো দুই মিয়ানমারের নাগরিক ১৪ দিন বাড়িতে আলাদাভাবে থাকতে রাজি হয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন হাতয়। আর বাকি সবাইকে নিয়ে বিমানটি গুয়াংঝুতে ফিরে গেছে। মিয়ানমারে এখন পর্যন্ত কারো করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েনি। ফলে দেশটি এখনো চীনের সাথে সীমান্ত বন্ধ করেনি কিংবা চীনা ভ্রমণকারীদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তবে বিমানবন্দর এবং সীমান্ত এলাকার প্রবেশপথে সবার দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষার পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি।
এ দিকে সিঙ্গাপুর করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। নতুন কোনো চীনা দর্শনার্থী কিংবা গত ১৪ দিন চীনে কাটিয়ে এসেছেন এমন কোনো বিদেশীকে সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। শুক্রবার এ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর গতকাল শনিবার থেকেই তা কার্যকর করার কথা জানিয়েছে সিঙ্গাপুর। সূত্র : সিএনএন, রয়টার্স ও আলজাজিরা।
Leave a Reply