অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা ঘটনায় আলোচনায় আসা সাবেক ও বর্তমান মিলে ২২ জন সংসদ সদস্যের (এমপি) দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই তালিকার মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন ১২ জন এবং সাবেক ১০ জন। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাস জমি দখল, ঘুষ গ্রহণ, কমিশন, চাঁদাবাজিসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
এ দিকে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল এবং তার স্ত্রী এমপি (সংরক্ষিত আসন) সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পচারের অভিযোগে গতকাল বুধবার মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলায় আরো আসামি করা হয়েছে পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরে এই প্রথম দুদক একত্রে দুইজন এমপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা দায়ের করল।
দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে দুইজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২২ জন সংসদ সদস্যের বিষয়ে তিনি বলেন, অন্যদের ব্যাপারে আমাদের কার্যক্রম চলছে। আশাকরি শিগগিরই ব্যবস্থা নিতে পারব। তিনি বলেন, আমরা থেমে নেই; সে যে দলেরই হোক না কেন।
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিসহ নানা ঘটনায় এর আগে সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে ২১ জন সংসদ সদস্যের দুর্নীতির খোঁজে নামে দুদক। সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় যোগ হলেন আরো একজন সংসদ সদস্য হাজী মো: সেলিম। ছেলের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগ আসার পর তুমুল আলোচনার মধ্যে প্রভাবশালী ও অর্থশালী হাজী সেলিমের অবৈধ সম্পদের খোঁজে নামার কথা জানান দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান।
প্রসঙ্গত, দুদক যাদের সম্পদের খোঁজ করছে তারা হলেন- বর্তমান সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সামশুল হক চৌধুরী, নজরুল ইসলাম বাবু, পঙ্কজ দেবনাথ ও আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তারা সবাই আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি। এ ছাড়া বিকল্পধারার মাহী বি চৌধুরী, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য গতকাল যাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করেছে তারা হলেন- কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম।
অপর দিকে সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বি এম মোজাম্মেল হক, কামরুল আশরাফ খান পোটন, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও শামসুল হক ভূঁইয়া। এই তালিকায় বিএনপি নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, মো: শাহজাহান, আব্দুল মোমিন তালুকদার, শহিদুজ্জামান বেল্টু। জাতীয় পার্টির এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের নামও রয়েছে এই তালিকায়।
বর্তমান ১১ সংসদ সদস্যের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয় এক বছর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় থেকে। সাবেক এমপিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয় তিন বছর আগে থেকে। সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে ২২ জন এমপির অনুসন্ধান চলমান বলে দুদক কর্মকর্তারা জানান। ইতোমধ্যে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাদের একাধিকবার দুদকে তলবও করা হয়। চাওয়া হয় তাদের সম্পদ বিবরণী।
সম্প্রতি রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীকে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তার বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাস জমি ইজারায় দুর্নীতি, সার ডিলার নিয়োগে অনিয়ম, স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে।
১০ থেকে ২০ শতাংশ ঘুষ নিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতাকে নিয়ে শুরু হয় দুদকের অনুসন্ধান। তার সম্পদ খতিয়ে দেখতে গত ৩ নভেম্বর সম্পদ বিবরণীসহ সব নথিপত্র তলব করে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর দুই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকা করে তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদক। ইতোমধ্যে এই তালিকা থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বেশ কয়েকজন আলোচিত নেতাসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।
ওই সময় দুদকের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তালিকায় উঠে আসে আওয়ামী লীগের পাঁচ সংসদ সদস্যের নাম। তারা হলেনÑ সুনামগঞ্জ-১ আসনের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সামশুল হক চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু ও বরিশাল-৪ আসনের পঙ্কজ দেবনাথ। তাদের সম্পদের পরিমাণ খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুদক।
ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীকে নিয়ে শুরু হয় দুদকের অনুসন্ধান। মাহী বি চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সম্প্রতি তার ও তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব জমা দিতে নোটিশ পাঠায় দুদক। একই অভিযোগে ভোলা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক।
জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এর অংশ হিসেবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একাধিকবার তলব করা হলেও নানা কারণ দেখিয়ে হাজির হননি তিনি।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হকের সম্পত্তিসংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি কয়েকটি দফতরে চিঠি দিয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
এমপি পাপুল দম্পতির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা : সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল এবং তার স্ত্রী এমপি সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, আসামিদের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জেসমিন প্রধানের পাঁচটি হিসাবের মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত পাচার করা হয় ১৪৮ কোটি টাকা। অথচ মাত্র বয়স ২৩ বছর বয়সী জেসমিনের নিজের কোনো আয়ের উৎস নেই।
অন্য দিকে এফডিআর হিসাবের ২ কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার কোনো উৎস শ্যালিকা জেসমিন দাখিল করতে পারেননি। যে কারণে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল এবং তার স্ত্রী এমপি সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে তা ভোগদখলে রাখার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় অভিযোগ এবং প্রায় ১৪৮ কোটি টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের দায়ে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে এজাহারে।
অর্থপাচারের উদ্দেশ্যে ‘লীলাবালি’ গড়ে তোলেন এমপি পাপুল : অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে মালিক দেখিয়ে ‘লীলাবালি’ নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল। ওই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জেসমিনের পাঁচটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৪৮ কোটি টাকা পাচার করেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জেসমিনের বয়স ২৩ বছর। তাকে মালিক দেখিয়ে সেলিনা ইসলাম এমপি ও সহিদ ইসলাম পাপুল নিজেদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের বৈধতা দেয়ার জন্য ‘লীলাবালি’ নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিভিন্ন ব্যাংকে জেসমিনের নামে প্রায় ৪৪টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে; যেখানে শুধু এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেই রয়েছে ৩৪টি এফডিআর হিসাব। পাপুল এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হওয়ায় এই সুবিধা নিতে তার কোনো বেগ পেতে হয়নি।
Leave a Reply