হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দীর্ঘদিন ধরেই স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের দিয়ে এ অপতৎপরতা চালাচ্ছে। পাচার হয়ে আসা স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিমানবন্দরে মাঝেমধ্যেই আটক হয় চক্রের যাত্রীবেশী সদস্যরা। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। কিন্তু কাউকেই আটকে রাখা যায়নি।
এসব ঘটনায় থানায় হওয়া মামলাগুলোর প্রায় সব আসামিই এখন জামিন নিয়ে লাপাত্তা। এদের কেউ দেশে আত্মগোপনে আছে, সুযোগ বুঝে কেউ কেউ পালিয়েছে বিদেশে। ফলে থমকে আছে অধিকাংশ মামলার তদন্ত কার্যক্রম। জব্দ স্বর্ণ ও মুদ্রার সুরাহাও আছে ঝুলে। আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। এ রাজস্ব আহরণে এখন নড়েচড়ে বসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও মুদ্রার বিষয়ে সুরাহার জন্য বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করছে তারা।
শাহজালাল বিমানবন্দরে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট ৬ কোটি টাকা মূল্যের ১২ কেজি স্বর্ণসহ আটক হন জাপানি নাগরিক টাকিও মিমুরা। ৭ জুলাই দেড় কোটি টাকার ২৮টি স্বর্ণবারসহ (সোয়া ৩ কেজি) গ্রেপ্তার হন জু জিয়াং নামে এক চীনা নাগরিক। ২৯ এপ্রিল ৩ কেজি ২৫০ গ্রাম ওজনের সোনাসহ ধরা পড়েন ভারতের কলকাতার আমির খান। ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি সাড়ে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি স্বর্ণসহ আটক করা হয় জাপানের নাগরিক কেনগো সিবাতাকে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের এ সদস্যরা গ্রেপ্তারের পর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। কিন্তু মামলা হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আদালত থেকে জামিন পেয়ে তারা এখন লাপাত্তা।
শুধু এই ৪ জনই নয়, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ গ্রেপ্তারের পর জামিন নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আরও ২৮ বিদেশি নাগরিক। তারা হলেন ভারতের ঈশ্বর দাস, সৌরভ ম-ল, রমেশ কুমার ভার্মা, সালেকিন শেখ, সৌমিক দত্ত, কুলদীপ সিং, ওয়াসিম, রমজান আলী, আরশাদ আয়াজ আহমেদ, গুজরাট সিং, প্রকাশ, রেখা, উর্মিলা কুমার, অনিক কুমার, বিনোদ কুমার, গুরজন্ত সিং, বিজয় কুমার, দিনেশ, রাশেদ মো. খালেদ। চীনের চেন সিম ফ্যাট, চেন জিলা, ডিং শোশেং, জু ইয়ংগাং, লুটেংচেং, জাপানের শুইচি সাতো। মালয়েশিয়ার চ্যান গী কিওনগ ও রাজা বসলিনা বিনতি। ক্যামেরুনের নোগোমবি বাছি। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩১টি। আসামি লাপাত্তা হওয়ায় মামলাগুলো এখন ঝুলে আছে।
জানা গেছে, এনবিআরের তালিকাভুক্ত এক আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২১ জুন ঢাকা কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার (আইন) রেবেকা সুলতানা ২০১৬-২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৫ বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা ও মাদকদ্রব্য আটকের পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেন। এর পর গত ১৯ অক্টোবর এনবিআরের আইন কর্মকর্তার মাধ্যমে রিটেইনার অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী এক চিঠিতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আসা ও বিদেশি নাগরিকের (যাত্রী) কাছ থেকে চোরাচালানের অভিযোগে আটক স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার (আলামতের) নমুনা রেখে রাজস্ব আহরণের স্বার্থে ডিসপোজাল করণের আবেদন করেন এনবিআরের দপ্তরে। ৩১টি ফৌজদারি মামলার তথ্যসহ যাবতীয় বিষয় মহানগর দায়রা জজ আদালতে লিখিত আবেদনেও সংযুক্ত করা হয়। আবেদনে আটক স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার নমুনা দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী জমার মাধ্যমে ডিসপোজালের ব্যবস্থা করতে আর্জি জানানো হয়।
এতে উল্লেখ করা হয়, শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন ফ্লাইটে বিদেশ থেকে আনা ৯৭ কেজি স্বর্ণ দেশের অভ্যন্তরে পাচার করা হয়। এ স্বর্ণের মূল্য সাড়ে ৪৮ কোটি টাকা। ৬ কোটি ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের বৈদেশিক মুদ্রাও বিদেশে পাচারকালে আটক হয়। স্বর্ণ আটকের মামলা করা হয় ২৬টি। বৈদেশিক মুদ্রা আটকের বিষয়ে মামলা ৫টি। জব্দ এসব স্বর্ণবার থেকে একটি স্বর্ণবার ও মুদ্রা থেকে প্রতি কেসে একটি করে বৈদেশিক মুদ্রার নোট নমুনা যৌথ স্বাক্ষরে (কাস্টমস ও বাংলাদেশ ব্যাংক) সংরক্ষণ করে বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি পূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আহরণ ও সংরক্ষণের স্বার্থে নিলামে বিক্রির জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়।
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন সময়ে ৩২ বিদেশি নাগরিক (যাত্রী) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণ শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে পাচারকালে কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আটক হন। ঢাকা কাস্টমস হাউস কমিশনার আটক যাত্রীদের কারণ দর্শানো ও শুনানির নোটিশ জারি করেন। কিন্তু কোনো যাত্রী নোটিশের জবাব দেয়নি। উপরন্তু আদালতে জামিনের দরখাস্তে সবাই উল্লেখ করেন তারা পরিস্থিতির শিকার। জব্দ স্বর্ণের মালিক নন তারা। পরে জামিন পেয়েই পলাতক হয়ে যান তারা। দ্বিতীয়বার আর আদালতে হাজির হননি। স্বর্ণগুলো তাদের কাছ থেকে আটক করা হলেও বিভিন্ন অজুহাতে তারা মালামালের দাবি না করে দেশ ছাড়েন। এ স্বর্ণের প্রতি যাত্রীদের দাবি নেই, তাই আটক পণ্যগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘জব্দ স্বর্ণগুলো বেআইনিভাবে চোরাচালানের উদ্দেশ্যে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পাচারের অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল আসামিরা। স্বর্ণবারের এখন পর্যন্ত কোনো দাবিদার পাওয়া যায়নি। ফলে মামলাগুলোর পণ্যের বিষয়টি সহজেই নিষ্পত্তিযোগ্য। বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রতি মামলায় আলামত সংরক্ষণ করে স্বর্ণের একটি বার ও একটি কারেন্সি নোট যৌথ স্বাক্ষরে নমুনা সংরক্ষণ করে নিলামে বিক্রি করে অর্থ রাজস্ব খাতে জমা করতে রাজস্ব আহরণ ও সংরক্ষণের স্বার্থে আদালতে আবেদন করা হলো।’
দাখিল করা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমদানি করে সঙ্গে আনতে পারে না। এটি বেআইনি। মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বর্ণগুলো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দাবি করেনি, তাই এগুলো বেওয়ারিশ হিসেবেই গণ্য। আর বেওয়ারিশ পণ্যের মালিক রাষ্ট্র। তাই পুরো পণ্যই রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তযোগ্য বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন এনবিআরের আইনজীবী।
গতকাল বুধবার এনবিআর কর্তৃক নিযুক্ত রিটেইনার অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী আমাদের সময়কে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে বিভিন্ন সময় স্বর্ণ ও মুদ্রাসহ আটক বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলার নথি যাচাই-বাছাই শেষে এনবিআর চেয়ারম্যানের দপ্তরে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এনবিআরের আইন কর্মকর্তা ওয়াহেদুর রহমান জানান, এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশই চূড়ান্ত। জব্দ স্বর্ণ ও মুদ্রার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে।
Leave a Reply